এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই

  • তাজা বুলবুলভাজা...
    সাতাশ সেকেন্ড, মৃত্যুর মুখোমুখি - সোমনাথ গুহ | লেখক সলমান রুশদি নিজেই এক চলমান থ্রিলার; বিতর্ক, প্রতিবাদ, বিক্ষোভ তাঁর সাহিত্যের সাথে হাত ধরাধরি করে চলে। ভারতীয় ইংরাজি সাহিত্যে তাঁর আত্মপ্রকাশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। ১৯৮১তে প্রকাশিত তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস বুকার তো পেয়েছিলই, এছাড়াও ১৯৯৩ এবং ২০০৮ সালে যথাক্রমে বুকার পুরস্কারের ২৫তম এবং ৪০তম বার্ষিকি উপলক্ষে দুবার ‘বুকার অফ বুকারস’ সম্মানে ভূষিত হয়েছিল। জাদু বাস্তবতার ধারায় লেখায় এই বইয়ে বর্ণীত উপমহাদেশের ইতিহাস পাশ্চাত্যে প্রবল ভাবে জনপ্রিয় হলেও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সম্পর্কে একটি ‘কটূক্তির’ কারণে ভারতে বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল।তাঁর পঞ্চম উপন্যাস ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ প্রকাশিত হওয়ার পর তো লঙ্কাকাণ্ড বেধে গেল। ১৯৮৯ এর ফেব্রুয়ারি মাসে ইরানের ধর্মীয় নেতা আয়াতোল্লা খোমেনি ওই বইয়ে ইসলাম ধর্মের অবমাননা করার কারণে লেখকের মৃত্যু কামনা করে ফতোয়া জারি করেন। লেখক আত্মগোপন করেন, ভারত সহ নানা দেশ বইটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ১২ই অগস্ট, ২০২২, এক আততায়ীর আক্রমণ থেকে প্রায় অলৌকিক ভাবে রক্ষা পেয়ে ওই অভিজ্ঞতার ওপর লিখিত তাঁর সাম্প্রকিতম ‘নাইফঃ মেডিটেশন্স আফটার অ্যান অ্যাটেমটেড মার্ডার’ বইয়ে লেখক তাঁর ফতোয়ার দিনগুলিতে বারবার ফিরে গেছেন। ঘটনার প্রায় আট মাস বাদে লন্ডনে পোঁছে রুশদি চৌত্রিশ বছর আগের দিনগুলো স্মরণ করছেন যখন কিছু এয়ারলাইন্স তাঁকে বহন করতে ভীত ছিল, অজ্ঞাত কারণে তাঁর হোটেল বুকিং বাতিল হয়ে যেত, প্রকাশ্য জায়গায় যাওয়া বারণ ছিল, একান্ত পারিবারিক মিলনের সময়েও পুলিশের চর ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলত, যখন তাঁকে সর্বত্র ‘অদৃশ্য’ থাকতে বলা হতো। কিন্তু এই সাড়ে তিন দশকে বিশ্ব তো পালটে গেছে। সোভিয়েত ইউনিয়ানের পতন ঘটেছে, ৯/১১ ঘটে গেছে, আল-কায়দা, আইসিসের উত্থান পতন হয়েছে, প্রযুক্তির অভাবনীয় উল্লম্ফন ঘটেছে, সর্বোপরি লেখকের আরও প্রায় পঁচিশটি গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ সংকলন প্রকাশিত হয়েছে; মানুষ রুশদিকে ‘দ্য মুরস লাস্ট সাই’ বা তাঁর আত্মজীবনী ‘জোসেফ অ্যান্টন’-এর লেখক হিসাবে চেনেন, ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ তাঁরা প্রায় ভুলে গেছেন। এখন লন্ডনে গেলে তিনি যে কোন জায়গায় যেতে পারেন, পুলিশ আড়ালে আবডালে নজর রাখেন; কোন বন্ধু, আত্মীয়র বাড়ি গেলে তাঁরা ঘরে ঢুকে পাশে বসেন না, বাইরে অপেক্ষা করেন। তাহলে এখন কেন? নিউইয়র্কের শতকোয়ার অ্যাম্ফিথিয়েটারে তিনি যখন দেখলেন এক যুবক তাঁর দিকে দৌড়ে আসছে তখন ওই কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে প্রথম তাঁর মনে হলঃ তাহলে এটাই তুমি, এসে গেছ! দ্বিতীয় চিন্তা যা তাঁর মস্তিষ্কে ঝিলিক মারলঃ এতদিন বাদে? কতো দিন হয়ে গেল, এখন কেন, এতো বছর বাদে কেন? পৃথিবী তো অনেক এগিয়ে গেছে? ওই অধ্যায়টা তো সমাপ্ত, চ্যাপ্টার ক্লোজড!লেখকের ওপর আক্রমণটা এরজন্যই এতো বিস্ময়কর। তাঁকে এতটাই বিপদমুক্ত মনে করা হতো যে শতকোয়ায় কোন নিরাপত্তার ব্যবস্থাই ছিল না। পরে তিনি যখন লন্ডনে যান সিকিউরিটি অফিসার তাঁকে বলেন, ইংল্যান্ডে অন্তত আপনার কোন বিপদ আছে বলে আমাদের জানা নেই, কিন্তু কোথায় কোন উন্মাদ অপেক্ষা করে আছে কে জানে! হাদি মাতার সেই নিঃসঙ্গ নেকড়ে, লোন উলফ, যিনি লেখককে ভণ্ড মনে করতেন, যে ওই উপন্যাসের মাত্র দুটি পাতা পড়েছেন, ইউটিউবে ধর্মগুরুদের বাণী শুনে উদ্দীপ্ত হয়েছেন। কিন্তু দীর্ঘ দিন ধরে তিনি লেখকের প্রতি রাগ পুষে রেখেছেন, নিজেকে তৈরি করেছেন কিন্তু হায়, তবুও তিনি পেশাদার খুনি হতে পারেননি। অন্তত পনেরো বার তিনি তাঁকে ছুরি দিয়ে আঘাত করেছেন, চোখে, মুখে, বুকে, পেটে, হাতে, ঘাড়ে, তাঁর এক চোখ অন্ধ করে দিয়েছেন, তবুও তিনি তাঁকে হত্যা করতে পারেননি। পুত্র মিলন লেখককে জানান কতো ঘটনা আছে যেখানে ছুরির একটি মাত্র আঘাতে মৃত্যু ঘটে, আর তোমার ক্ষেত্রে... এই লেখায় ওপরে অলৌকিক শব্দটা ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু লেখক তো অলৌকিক, নিয়তি এসবে বিশ্বাস করেন না, তিনি নিখাদ নাস্তিক। ডাক্তার তাঁকে বলেন, জানেন আপনি কতো ভাগ্যবান? আপনার কপাল ভালো ওই ছেলেটা একটা মানুষকে কীভাবে ছুরি দিয়ে খুন করতে হয় জানে না। কিন্তু রুশদি তো ভাগ্যে-টাগ্যে বিশ্বাস করেন না, গুলি মারো ভাগ্য! তিনি আততায়ীকে করুণা করেন, যে এতটাই অপদার্থ যে পঁচাত্তর বছর বয়সের এক বৃদ্ধকে বারবার আঘাত করেও হত্যা করতে ব্যর্থ হয়। ছুরি যেমন হিংসার প্রতীক, ভাষাকে ছুরির মতো ব্যবহার করে সেই হিংসার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, তাকে প্রতিরোধ করা যায়। এই বিষয়ে লেখক মিশরের দিকপাল সাহিত্যিক নাগিব মাহফুজকে স্মরণ করেন। তিরিশ বছর আগে নোবেলজয়ী লেখক যখন হেঁটে কফির দোকানে যাচ্ছিলেন একটি গাড়ি তাঁর পাশে গড়িয়ে আসে। লেখক ভেবেছিলেন বোধহয় তাঁর কোন গুণগ্রাহী, কিন্তু এক ব্যক্তি লাফিয়ে নেমে তাঁর ঘাড়ে ছুরিকাঘাত করেন। কিছু দিন পূর্বে তাঁর একটি বই নিষিদ্ধ ঘোষণা হয়েছিল এবং তাঁর নাম ‘হিট লিস্টে’ উঠে গিয়েছিল। তিনি দেহরক্ষী রাখতে অস্বীকার করেছিলেন, বলেছিলেন, কী আসে যায় ওরা যদি আমাকে পেয়ে যায়? আমি আমার জীবন অতিবাহিত করেছি এবং আমার যা মনে হয়েছে তা করেছি। রুশদির বিরুদ্ধে ফতোয়া জারির পর একশো জন মুসলিম লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে তিনি তাঁর পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি যা বলেছিলেন তা চিরস্মরণীয়, একটা চিন্তাকে শুধুমাত্র অন্য চিন্তা দিয়ে বিরোধিতা করা যায়। যদি কাউকে শাস্তি দেওয়াও হয়, চিন্তাটা থেকেই যাবে, বইটাও থেকে যাবে। ২০২১ এর মে মাসে রুশদি আমেরিকান সাহিত্যিক এলিজা গ্রিফিথকে বিয়ে করেছিলেন। তাঁর জীবন স্বস্তি, শান্তি, ভালবাসায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। উক্ত ঘটনার মাত্র তিন মাস আগে তিনি পেন, আমেরিকার একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বক্তব্য রেখেছিলেন, যেখানে বিষয় ছিল বর্তমান বিশ্বের সংকট। তিনি বলেনঃ রাশিয়ায় এক স্বৈরাচারীর উত্থানের কারণে ইউক্রেন আজ নির্মম অত্যাচারের সম্মুখীন। আমেরিকা মধ্য যুগে ফিরে যাচ্ছে যেখানে শ্বেতাঙ্গরা শুধুমাত্র কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর খবরদারি করছে না, নারীর শরীরের ওপরেও প্রভুত্ব করার চেষ্টা করছে। ভারতে ধর্মীয় সংকীর্ণতাবাদ ও রাজনৈতিক কর্তৃত্ববাদ মাথাচাড়া দিয়েছে এবং হিংসা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে, গণতন্ত্রের বিনাশ ঘটছে। ইতিহাসের মিথ্যাচার হচ্ছে যা সংখ্যাগরিষ্ঠদের সুবিধা প্রদান করে, সংখ্যালঘুদের নিপীড়ন করছে; এবং এটা জানা দরকার এই যে মিথ্যা আখ্যানের ঢক্কানিনাদ শোনা যাচ্ছে তা জনপ্রিয়, মানুষ বিশ্বাস করছে, ঠিক যে ভাবে রাশিয়ার স্বৈরাচারীর মিথ্যাও সবাই বিশ্বাস করছে। এটাই আজকের বিশ্বের কুৎসিত বাস্তবতা। লেখকের ওপর আক্রমণের কয়েক ঘণ্টা পরেই প্রেসিডেন্ট বাইডেন, ফ্রান্সের মাকোঁ এমনকি ইংল্যান্ডের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন, যিনি মনে করেন রুশদি যথেষ্ট উচ্চমানের লেখক নন, তাঁরা ঘটনার তীব্র নিন্দা করে বিবৃতি দেন। কিন্তু তাঁর চৈতন্যে তাঁর বহু লেখার কেন্দ্রে যে দেশ ভারত তা এখনো সদা জাগ্রত। সেই দেশের প্রতিক্রিয়া তাঁকে মর্মাহত করে। তিনি লিখছেন, ভারত আমার জন্মস্থান, আমার প্রেরণা ওই দিন কোন কথা খুঁজে পায়নি। (২৫শে অগস্ট, ঘটনার প্রায় দু সপ্তাহ বাদে বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র ওই ঘটনার নিন্দা করেন।) রুশদি লিখছেন উলটে অনেকে উল্লাস প্রকাশ করেন; মানুষ তো ঘৃণা করবেই যদি চৌত্রিশ বছর ধরে তাঁকে ঘৃণার প্রতিমূর্তি করে গড়ে তোলা হয়। ঘৃণা, হিংসার এই বাতাবরণে একজন লেখক কী করবেন? রুশদি মিথিক্যাল গ্রিক পয়গম্বর, সংগীতকার অরফিউয়াসকে স্মরণ করছেন। তাঁর মাথা ছিন্ন করে যখন তাঁকে হেব্রাস নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল তখনও অরফিউয়াস গান থামাননি, তাঁর সংগীত দূরদূরান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই ভয়াবহতার আবহে আমাদেরও আজ গান গেয়ে যেতে হবে, জোয়ারের দিক পরিবর্তনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। KNIFE: MEDITATIONS AFTER AN ATTEMPTED MURDERSALMAN RUSHDIEPENGUIN RANDOM HOUSE, INDIA
    আমার জার্মানি - জলের ধারে বসে থাকার স্মৃতি - অভিজিৎ সেন | ছবি: রমিত চট্টোপাধ্যায়‘আমার জার্মানি’ বইটা পড়ে শেষ করার পর খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকা ছাড়া উপায় নেই। তবে হ্যাঁ, যদি কেউ বলেন যে আমি এই বইটা এক নিঃশ্বাসে পড়ে শেষ করেছি তাহলে তাঁকে বলতেই হবে যে ক্ষমা করবেন মহোদয়, আপনার বোধহয় কোথাও ভুল হচ্ছে’, কারণ ওটা সম্ভব নয়। এ বই পড়তে হবে থেমে থেমে, রসিয়ে রসিয়ে, অনুভব করে করে, প্রত্যেকটা অনুচ্ছেদের মর্ম অনুধাবন করে। যে কথা গুলো প্রথমেই মনে হচ্ছে, সেগুলো বলি। প্রথমত, লেখকের স্মরণশক্তি। প্রত্যেকটি ঘটনার এ রকম সন তারিখ সহ বিস্তৃত বর্ণনা দিতে যে অকল্পনীয় স্মৃতিশক্তির প্রয়োজন তা খুব কম মানুষের থাকে। কুর্ণিশ।দ্বিতীয়ত, রসবোধ। মুজতবা আলী সাহেবের কথা মাথায় রেখেই বলা যায় তাঁর একজন উত্তরসূরি বোধহয় খুঁজে পাওয়া গেল। সময় তা বলবর, কিন্তু আশা পোষণ করার যথেষ্ট যৌক্তিকতা আছে।তৃতীয়ত, সাহিত্যের সঙ্গে অনুভূতির মেল বন্ধন। জলপাইগুড়িতে ব্যাংকিংএর প্রথম পাঠ নেওয়ার স্মৃতি আজও অমলিন -জলের ধারে বসে থাকার স্মৃতি কখনো কি মুছে যায়! আমাদের একসাথে বসে সেই শক্তি -সুনীল- তারাপদ রায়ের কবিতা পড়া! শুধু সেই সব কবিতা নয়, সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ তো আছেনই, যাযাবর এমনকি বঙ্কিমও আছেন। এসব মনিমুক্তো ছড়িয়ে আছে অজস্র। কিন্তু বইটা শেষ করার পরে যে রেশটা মনের ভেতরে অনুরণিত হতে থাকে সেটা ভাষা, বর্ণনা এবং অনুভূতির একটা অনবদ্য মিশ্রণ। পদুমা গ্রাম, মায়ের কথা, জলপাইগুড়ির দিনগুলো, জার্মানিতে প্রথম কাটানো সেই শীতার্ত রাত্রি, ইজারলোন, হেলমুটের কাছে বসে নুরেমবেরগের নাৎসি কংগ্রেসের স্টেডিয়াম বানানোর গল্প, শহরের ধ্বংস ও পুনরুত্থান, নির্বিচারে ইহুদি নিধন, কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের বীভৎসতা, জার্মানির বঙ্গ সমাজ, অক্টোবর ফেসটের জাঁকজমক, চেকোস্লোভাকিয়ার প্রত্যন্ত গ্রামে অরটউইনের জন্মভূমির খোঁজে অভিযান -অসাধারণ সব বর্ণনা। তবে সব কিছু ছাপিয়ে আমার মনের মধ্যে যে তিনটে দৃশ্য দাগ কেটেছে তা এইরকম- প্রথম দৃশ্য - ফ্রাঙ্কফুর্টের এক পানশালায় গুলতানি জমে উঠেছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ জার্মান। সেখানে সহসা হাজির হীরেনের বসের পিতৃদেব, অবসরপ্রাপ্ত আমেরিকান সেনাধ্যক্ষ, ডেভিড। বয়স্ক মানুষ, উঁচু আমেরিকান উচ্চারণে ইংরেজি বলেন, যুদ্ধকে ঘৃণা করেন। জার্মানদের সঙ্গে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রথম সাক্ষাৎকার এবং যুদ্ধের গল্প বলতে শুরু করলেন। সবাই শুনছে, যারা ইংরেজি খানিকটা জানে তারা মোটামুটি বুঝতে পারছে, বাকিরা পারছে না। এক সময়ে একজন বয়স্ক জার্মান এগিয়ে এলেন, হীরেনকে বললেন আমি ওঁর সব কথা বুঝতে পারছি না, কিন্তু একটা কথা জানতে চাই -অমুক দিন অমুক যুদ্ধের সময় উনি কি সেখানে উপস্থিত ছিলেন? ডেভিডকে বলা হলে তিনি বললেন, হ্যাঁ। পরের প্রশ্ন- উনি কি মনে করতে পারেন সেদিন একজন শত্রুপক্ষের সৈন্যকে গুলি না করে গ্রেপ্তার করেছিলেন? উত্তরে ডেভিড বললেন যদিও গুলি করাই দস্তুর কিন্তু আমার কাছে সব যুদ্ধই অর্থহীন। সুতরাং আমি কাউকেই গুলি করিনি। তবে সেদিন একজন নিরস্ত্র জার্মান সৈনিককে আমি আমার উপরওলার হাতে তুলে দিয়েছিলাম। বয়স্ক জার্মান ভদ্রলোক এবার উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, আমি সেই সৈনিক। ডেভিড উঠে দাঁড়ালেন। দুজনে দুজনের দিকে এগিয়ে গেলেন। চার দশক আগের দুই শত্রু একে অপরকে আলিঙ্গন করলেন। দৃশ্য দুই। ইয়েন্সের সঙ্গে পরিচয় হল বার্লিনে। অল্প সময়ের মধ্যে বন্ধুত্ব, আলাপ জমে উঠলো - চলুন আপনাকে ওই বই পোড়ানর জায়গাটা দেখিয়ে আনি। নানা গল্প। হীরেন একটু বিস্মিত, পুলকিত। একসময়ে ইয়েন্স বললেন আসুন আপনাকে আমার একটা খুব প্রিয় দৃশ্য দেখাই। খানিক এগিয়ে হঠাৎ একটা ফ্ল্যাট বাড়ির দরজা ঠেললেন, দরজা খুলে গেল। সামনে সিঁড়ি। ম্লান মৃদু একটা আলো। ইয়েন্স বললেন আসুন। সিঁড়ি বেয়ে চার তলা। ল্যান্ডিঙে একটা কাঁচহীন বড়ো জানলা। ইয়েন্স বললেন, বাইরে তাকান। হীরেন দেখলেন সামনে একশ মিটার দূরে বার্লিন ওয়াল। চোখের সামনে আধো অন্ধকারে আশ্চর্য অপরিচিত সব দৃশ্য; ওপারে পশ্চিম বার্লিনের অজস্র ঝলমলে আলো, এপারে কাঁটা তার, পরিখা, অন্ধকার। সাম্যবাদের সঙ্গে ধনতন্ত্রের মুখোমুখি দেখা। ইয়েন্স বললেন, জানেন এটা আমার ফ্ল্যাট নয়, তবু আমি এখানে আসি। সন্ধ্যেয় যখন ওদিকে আলো জ্বলে ওঠে, এই জানালায় দাঁড়াই আর ওদিকে তাকিয়ে থাকি। দেখি আরেকটা উজ্জ্বল জগৎ আছে, মুক্তি আছে। হয়তো একদিন আমি সেখানে যাবো। হীরেন নিশ্চুপ। ধনীর দুয়ারে দাঁড়ায়ে কে গো ওই কাঙ্গালিনীর মেয়ে? সংযোজন অনবদ্য। দৃশ্য তিন। ইউরোপে হীরেনের প্রথম গুরু অরটউইন, পরবর্তীকালে অভিন্নহৃদয় বন্ধু, মন্ত্রণাদাতা ও পথ প্রদর্শক। অরটউইনের সঙ্গে কাজ শেখা, কাজ করা, পারিবারিক সম্পর্কের মতন তৈরি বন্ধুত্ব। প্রায় চার দশক জুড়ে সেই সম্পর্কের পরিধি। অরটউইনের জন্মস্থান চেকোস্লোভাকিয়ার এক গণ্ডগ্রামে শেকড়ের সন্ধানে একত্রে অভিযান। কেটে গেল মাস বছর -চাকরি বদল, কিন্তু সম্পর্ক অটুট, আরও আরও গভীর। তারপর নেনডরফের সানাটোরিয়ামে অরটউইনের ভর্তি হওয়া (কোন গুরুতর অসুখ নয়, হাড়ের ব্যথা, গাঁটের ব্যথা সারানোর জন্যে উষ্ণ প্রস্রবণের জলে স্নান এবং সঙ্গে চিকিৎসা) সেখানে তাকে দেখতে যাওয়া এবং থাকার নানা কৌতূহলোদ্দীপক গল্প। দিন কেটে যায়। পাকস্থলীতে সঙ্কট ধরা পড়লো অরটউইনের। সাল ২০০১। বাদ বেরকা সানাটোরিয়ামে ভর্তি। খবর পেয়ে হীরেন দৌড়ালো সেখানে। অরটউইনের সঙ্গে দেখা হল। যে মানুষটা এক সময় একটার পর একটা সিগারেট খেতো তার এখন সিগারেট খাওয়া বারণ। অরটউইন জানাল ফ্রাঙ্কফুর্টের ডাক্তাররা তাঁর রোগ নির্ণয় করেছেন। কোলনে ক্যান্সার। কেমো থেরাপি চলছে। তার পরেও লড়াই চলেছে আরও চোদ্দ বছর। শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর কাছে জীবন হার মানলো। চলে গেল অরটউইন।হীরেন আরও লেখো?পরিশিষ্ট কিছু মুদ্রণ প্রমাদ চোখে পড়লো। জলপাইগুড়ির বন্যা একজায়গায় লেখা হয়েছে ১৯৬৮ তারপরেই ১৯৭২। অরটউইনের নামের বানান বইয়ের ভেতরে লেখায় এবং ছবিতে আলাদা। একটা এত ভালো বইয়ে এটুকু খুঁতই বা থাকবে কেন? দেড়শ সার্চলাইটের মধ্যে একটা ফিউজ হয়ে গেলে আলো একটুও কমে না কিন্তু তাই বা হবে কেন?এবার হাড়িকাঠে গলা দেওয়ার জন্য তৈরি হই।কমলহীরের কাছে আমরা কী প্রত্যাশা করি? ভার না দীপ্তি? নাকি ভারসাম্য?ভার কি একটু বেশি হয়ে গেছে?আমার জার্মানিহীরেন সিংহরায়প্রকাশক: দে পাবলিকেশনস
    স্লোভাকিয়া ৩ - হীরেন সিংহরায় | ব্রাতিস্লাভার রাস্তায়ব্রাতিস্লাভা:একটি স্মারকের উপাখ্যান টেনিস পটীয়সী সেরেনা উইলিয়ামস উইমবলডনের অল ইংল্যান্ড টেনিস টুর্নামেন্টের কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছেন; একজন রিপোর্টার জিজ্ঞেস করেলেন, পরের রাউন্ডে কার সঙ্গে খেলবেন জানেন কি ? উত্তরে সেরেনা বলেন,জানি না,ওই কোন ওভা হবে।অনুমানটা আংশিক সত্য।বার্লিন ওয়ালের পতন এবং ইউরোপের পূর্ব দিগন্তের লৌহ যবনিকা উন্মোচিত হবার পরে গত তিরিশ বছরে মহিলা টেনিসে পোল্যান্ড থেকে সার্বিয়া,চেক থেকে রাশিয়া কাজাখস্তানের খেলোয়াড়রা সম্পূর্ণ ভাবে বিনষ্ট করেছেন ব্রিটেন, আমেরিকা, ফ্রান্স ও অস্ট্রেলিয়ার মৌরুসি পাট্টা। কম্যুনিস্ট আমলে আমরা পেয়েছি চেকোস্লোভাকিয়ার ইয়ারোস্লাভ দ্রবনি, ইয়ান কোদেশ, সোভিয়েত ইউনিয়নের আলেকস মেত্রেভেলি (জর্জিয়ান),রোমানিয়ার ইওন সিরিয়াক, ইলি নাস্তাসে কিন্তু মেয়েদের বিশেষ দেখা যায় নি। আজকে পাশা একেবারে উলটে গেছে; পুরুষদের অনেক পেছনে ফেলে অজস্র উজ্জ্বল মহিলা তারকা আলো করে রেখেছেন দুনিয়ার টেনিসের কোর্ট।রাশিয়ান, চেক, স্লোভাক, বুলগারিয়ান মেয়েদের নাম শেষ হয় ওভা অথবা এভা দিয়ে; বিয়ের আগে পিতার পদবি এবং বিয়ের পরে স্বামীর পদবির সঙ্গে সম্পর্ক সূচিত করে সেটি যুক্ত হয়। রাশিয়ান মারিয়া শারাপোভা,আনা কুর্নিকোভা,স্লোভাক দানিয়েলা হানটুকোভা,চেক পেত্রা কিতোভা বুলগারিয়ান কাতারিনা মালেভার নাম সকলের জানা। অবশ্য ব্যতিক্রম আছে; কখনো এ যোগ করেও একই উদ্দেশ্য সাধিত হয় যেমন পুতিনের স্ত্রী পুতিনা, কিন্তু পুতিনের দুই কন্যার বিবাহিতা নাম যথাক্রমে কাতারিনা তিখোনোভা এবং মারিয়া ভরন্তসোভা। রাশিয়ান টেনিস প্লেয়ার দিনারা সাফিনার দাদার নাম মুরাত সাফিন,তিনিও ছিলেন টেনিস স্টার। চেকে যেমন নাভ্রাতিলোভের ( আন্তন নাভ্রাতিলোভ নামের এক চেক ব্যাঙ্কারকে চিনতাম, প্রাগের চেসকোস্লভেন্সকি অবখদনি বাঙ্কায়) মেয়ে নাভ্রাতিলোভা,এবার তিনি যদি স্টেপানকে বিয়ে করেন তার বিবাহিতা নাম হবে স্টেপানোভা। তেমনি নোভোতনির মেয়ে নোভোতনা; ইয়ানা নোভোতনা ১৯৯৮ সালে উইম্বলডনে বিজয়ী হন। টেনিসে আরেক সফল দেশ বেলারুশেও ‘এ রুল’ চালু,যেমন আরিনা সাবালেঙ্কা,তাঁর পিতা আইস হকি প্লেয়ার সেরগে সাবালেনকো। পোলিশ মেয়েরা সাম্প্রতিক কালে টেনিসে অসাধারণ ফলাফল দেখিয়েছেন কিন্তু তাঁরা ওভার দলে পড়েন না। সাধারণত তাঁদের নামের শেষে আ-কার যোগ হয় যেমন আনিইয়েস্কা রাদভান্সকা ( সিটি ব্যাঙ্কে আমাদের উকিল স্টেফান স্কালস্কির সঙ্গে বিয়ের পরে তার এককালের জার্মান বান্ধবীর নাম ক্লদিয়া হর্ন থেকে হলো ক্লদিয়া স্কালস্কা) অথবা স্ট্যানিস্লাভস্কির স্ত্রী স্ট্যানিস্লাভস্কা। লন্ডনের গ্রিনডলেজ ব্যাঙ্কে অনেকদিন আগের পরিচিত পাভেল পোলানসকি ঠাট্টা করে বলতেন আমরা সবাই স্কি ক্লাবের মেম্বার! পোল্যান্ডে বহু নাম শেষ হয় ভিচ (wicz) দিয়ে,এই লেজুড় পিতৃ পরিচয় স্থাপনা করে, সেটি পুত্র কন্যা বিশেষে বদলায় না। বলকানে বিশেষ করে সার্বিয়া,ক্রোয়েশিয়াতে ভিচের (vic) অথবা ইচের (ic) ছড়াছড়ি – যেমন আইনস্টাইনের প্রথম স্ত্রী মিলেভা মারিচ, সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ইভো আন্দ্রিচ (“ দ্রিনার ওপরে সেতু”) নোভাক জোকোভিচ;ক্রোয়েশিয়ান ফুটবলার লুকা মদরিচ ( রিয়াল মাদ্রিদ )। রোমানিয়াতে ভিচ বা ইচের তুল্য হলো স্কু যেমন চাউসেসকু কিন্তু বুলগারিয়া বাদে গোটা বলকানের কোথাও মেয়েদের পদবির সঙ্গে কোন অক্ষর যুক্ত হয় না – রোমানিয়ান স্টার সিমোনা হালেপের বাবা স্টেরে হালেপ, সারবিয়ান স্টার আনা ইভানোভিচ জার্মান ফুটবলার শোয়াইনস্টাইগারকে বিয়ে করেছেন কিন্তু তিনি কোন ইভানকোভিচকে বিয়ে করলে হতেন আনা ইভানকোভিচ। সার্বিয়ার সর্বকালের সেরা মহিলা টেনিস খেলোয়াড় মনিকা শেলেশ আদতে হাঙ্গেরিয়ান। নোভি সাদে গিয়ে দেখেছি যে দুই মহিলাকে নিয়ে সে শহর সবিশেষ গর্বিত তাঁরা মিলেভা মারিচ ও মনিকা শেলেশ। হাঙ্গেরিয়ান ভাষাটাই গোটা ইউরোপ থেকে আলাদা - মেয়েদের নামেও সেখানে কোন এভা ওভা অথবা আ-কার ই-কারের বালাই নেই।পিতার পরিচয়ে সন্তানের পরিচয় একটি প্রতিষ্ঠিত প্রথা। তবে প্রত্যেক প্রজন্মে সেটি বদলে যায় না (ব্যতিক্রম শুধু ইহুদিদের ক্ষেত্রে;সেটা চালু ছিল অষ্টাদশ শতক অবধি এবং বর্তমান আইসল্যান্ডে )। আমাদের দেশে কোনো কালে এক মাধবের পুত্রের নাম দেওয়া হয়েছিল মাধবানি সেটাই থেকে গেছে, মাধবানির পুত্র/ কন্যাও মাধবানি। কৃষ্ণের পুত্র কৃশনানি।অগ্রিম ক্ষমা চেয়ে নিয়ে জানাই, নাম মাহাত্ম্য নিয়ে আজ এই বৃহৎ গৌরচন্দ্রিকার করার কারণ আমাদের দেশের একজন মহিলা!শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী!পুরনো ব্রাতিস্লাভা প্রথম ঘুরেছি আমাদের অফিসের ইভেতার সঙ্গে। সদ্য উন্মুক্ত ম্যাকডোনালডের সোনালি আর্চের উলটো দিকে আমাকে একটা বাড়ির কোনায় দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলল ‘দেওয়ালে কি লেখা আছে মন দিয়ে পড়ো। তুমি পুরোটার মানে বুঝবে না, এটা স্লোভাক ভাষা। কিন্তু দুটো নাম চিনতে পারবে। এঁরা তোমার দেশের লোক ছিলেন’। সেই নাম ফলক২০ আগস্ট ১৯৩৮সাক্ষাতের স্মরণেজওহরলাল নেহরুতস্য কন্যাইন্দিরা গান্ধিওভাএবংভ্লাদিমির ক্লেমেন্তিস*ভারতের স্লোভাক ও চেক বন্ধুরাব্রাতিস্লাভা - শান্তির শহর ১৯৩৮ সালে নেহরু কৃষ্ণ মেনন ও কন্যা ইন্দিরাকে সঙ্গে নিয়ে ইউরোপে গিয়েছিলেন। ভারতের স্বাধীনতা দাবিতে লন্ডনের ট্রাফালগার স্কোয়ারে তাঁদের সভায় পাঁচ হাজার লোক জমায়েত হন। স্পেনের গৃহযুদ্ধে রিপাবলিকান পক্ষের প্রতি ভারতের সমর্থন জানাতে সে দেশেও যান। ইউরোপের অবস্থা,বিশেষ করে চেকোস্লোভাকিয়ার পরিস্থিতি তখন অগ্নিগর্ভ- হিটলার নিত্যদিন শাসাচ্ছেন সে দেশের অর্ধেক তাঁর প্রাপ্য নইলে তিনি সেনা পাঠিয়ে জবর দখল করবেন। প্রাগের বিপন্ন সরকার খুঁজছেন আন্তর্জাতিক সচেতনতা,সহায়তা। ব্রাতিস্লাভায় এই মিটিঙের পাঁচ সপ্তাহ বাদে ২৯শে সেপ্টেম্বর, ১৯৩৮ ব্রিটেনের প্রধান মন্ত্রী চেম্বারলেন ও ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী এদুয়ারদ দালাদিয়ে তৎকালীন চেকোস্লোভাকিয়ার পশ্চিম ও পূর্বের অংশ (বেশির ভাগ জার্মান অধ্যুষিত সুদেতেনলানড) হিটলারকে উপঢৌকন দিয়ে বললেন,‘এবার ঝুট ঝামেলা বাড়াবেন না, শান্তি বজায় রাখুন’। যাদের দেশের ভাগ বাঁটোয়ারা হচ্ছে যে সভায় সেই চেকোস্লোভাকিয়ার কোন প্রতিনিধি সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। এই সুযোগে পোল্যান্ড খুবলে নেয় উত্তরের কিছু জমি এবং হাঙ্গেরি দখল করে আজকের স্লোভাকিয়ার অংশ বিশেষ (মিউনিকের এই মহান সন্তুষ্টিকরন বা অ্যাপিজমেনট অনুষ্ঠানের আলোচনায় আমরা পোল্যান্ড ও হাঙ্গেরির জমি ডাকাতির কথাটা কখনো শুনতে পাই না)।ছ মাস বাদে জার্মান সৈন্য চেকোস্লোভাকিয়ার সম্পূর্ণ দখল নেয়।বাকিটা ইতিহাস। নেহেরুর নামের ডাকটিকিট প্রায় ষাট বছর আগের এই ফলকে বানান অন্য রকম হলেও জওহরলাল নেহরুকে চিনলাম। ইংরেজি বাদে প্রায় কোনো ইউরোপীয় ভাষায় ‘জ’ ধ্বনির সমার্থক কোন অক্ষর নেই। স্লোভাকে ডি জেড দিয়ে সেই ধ্বনি সৃষ্টি করা হয়েছে (জার্মান ভাষায় এই একই ধাঁচে লেখা হয়) কিন্তু নেহরুর পরে যিনি উল্লেখিত,তাঁকে আমরা চিনি অন্য নামে। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধির নাম পরিবর্তন করে তাঁকে গান্ধিওভা বানানো হয়েছে। তাঁরও ছাড় নেই, তাঁকেও পরিচিত হতে হবে স্লোভাক কায়দায়,স্বামীর নামের সাথে ‘ওভা’ যুক্ত হয়ে। বিশ বছর বাদে,১৯৫৮ সালের কার্লোভি ভারি (জার্মান কারলসবাদ,চার্লসের স্নানাগার!) ফিলম ফেস্টিভালে মাদার ইন্ডিয়া ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার পেলেন নারগিসোভা! এখানে একটু শর্টকাট নেওয়া হয়েছিল,সঠিক আইন মানলে পুরস্কার ফলকে লেখা হতো নারগিস রাশিদোভা (তাঁর বাবার নাম আবদুল রাশিদ) সুনীল দত্তের সঙ্গে ততদিনে বিয়েটা হলে তিনি হতেন নারগিস দত্তভা (প্রসঙ্গত এক মেক্সিকান অভিনেত্রীকে বাদ দিলে কার্লোভি ভারি ফেস্টিভালে নন কমিউনিস্ট দেশের কেউ পাত্তা পেতেন না – নারগিস সেই ট্র্যাডিশন ভাঙ্গেন,এর পরে ১৯৭২ সালে রঞ্জিত মল্লিক ইন্টারভিউ ছবির জন্য বেষ্ট অ্যাকটর এ্যাওয়ার্ড পান)। স্লোভাকিয়াতে ফিল্মের পোষ্টারে,খবর কাগজে,টেলিভিশনে শ্যারন স্টোন হন শারনে স্টোনোভা, মেরিলিন মনরো হয়ে যান মেরিলিন মনরোভা।ছেলেদের নামের ওপরেও কঠোর অস্ত্রোপচার হতে দেখেছি পূর্ব ইউরোপের আরেক দেশে, লিথুয়ানিয়াতে। সেটা অন্য গল্প।পুরনো ব্রাতিস্লাভা – স্তারে মেসতো ব্রাতিস্লাভার পথে পথে পুরনো শহর ( স্টারে মেসতো ) ধাপে ধাপে নেমে গেছে দানিউবের ঘাটে। সেখান থেকে ছবিটি অতীব মনোরম। বাঁধানো চত্বরে হাঁটলে মনে হবে টাইম মেশিনে চড়ে আপনি কয়েকশ বছর পিছিয়ে গেছেন। জীর্ণ পুরাতনের প্রতি শ্রমিক কৃষকের সরকারের অসীম অনীহা দেখেছি একাধিক দেশে। কি ভাগ্যে প্রাগ, ভিলনিউস, টালিন, বুদাপেস্ট বেঁচে গেছে। বুখারেস্টকে স্মৃতির ভার থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করার সঙ্কল্প যিনি নিয়েছিলেন সেই নিকোলা চাউসেস্কুর অকালে নিধন না হলে তিনি সে কাজটি নিশ্চয় সম্পূর্ণ করতেন। স্তারে মেসতোর চারটে পাড়া ছিল যার মধ্যে দুটি – ভিদ্রিতসা এবং সুকারমানডেল সোভিয়েত আমলে ভেঙ্গে ফেলা হয়। যাকে সোভিয়েতরা ভেঙ্গে উঠতে পারেন নি অসম্ভব যত্নের সঙ্গে তার সংস্কার করা হয়েছে,সেটি আজ দুনিয়ার মানুষ দেখতে আসেন। দানিউবের অন্য পাড়ে অবশ্য সোভিয়েত স্থপতি কলা কৌশলীরা আরেক ব্রাতিস্লাভা সৃষ্টি করে গেছেন যাকে ব্রুটালিস্ট আর্ট বলা হয় সেখানে যাবার টুরিস্ট বাস দেখি নি। জানি ব্রাতিস্লাভা আপনাদের ভ্রমণ তালিকায় স্থান পাবে না, আপনারা যাবেন প্রাগে। ভ্লাতাভা (মলদাউ) নদীর ওপরে চার্লস ব্রিজের (কার্লস ব্রুইকে) ডজন খানেক পাথুরে মূর্তির পাশে দাঁড়িয়ে সাতটা সেতু দেখবেন,প্রাগ দুর্গকে পেছনে রেখে ছবি তোলাবেন, আরেক প্রস্তর তোরণ পেরিয়ে চলে যাবেন বিশাল ওয়েনসেসলাস স্কোয়ারে। ব্রাতিস্লাভার সপক্ষে বলি, ভিয়েনা থেকে স্পিড বোট বা ট্রেন ধরে একদিনের জন্যে আসুন ব্রাতিস্লাভা,মাত্তর এক ঘণ্টা লাগে। একটি ওয়ার্নিং – স্টেশন এলাকাটি মোটে আকর্ষণীয় নয়, সোভিয়েত আমলের শিল্প। জানি,জার্মান স্থাপত্যকর্মে ভরা প্রাগ এক অসাধারণ সুন্দর শহর কিন্তু ব্রাতিস্লাভায় পাবেন সারা ইউরোপের হাতের,ছেনির কাজ! রোমানরা ব্রাতিস্লাভা দুর্গের ভিত গড়েছেন দু হাজার বছর আগে, শেষ করেছেন হাঙ্গেরিয়ানরা। পাহাড়ের ওপরে সেই কেল্লার প্রাচীরে দাঁড়ালে পরিষ্কার দিনে অস্ট্রিয়া ও হাঙ্গেরি দুই দেশের সীমানা দেখা যায়, ইউরোপের একমাত্র দৃষ্টান্ত। তিনশ বছর ছিল হাঙ্গেরিয়ান রাজধানী,মারিয়া থেরেসার আমল থেকে অস্ট্রিয়ান ও হাঙ্গেরিয়ান স্থাপত্য কলার সংমিশ্রণ। রাজা ফারদিনান্দের স্ত্রী,স্পেনের রাজকন্যা মারিয়ানা দিয়ে গেছেন তাঁর দেশের কিছু স্মৃতি, তেমনি পাবেন ফরাসি, জার্মান ও অনিবার্যভাবেই ইতালিয়ান ছোঁয়া। ব্রাতিস্লাভার ইহুদি ইতিহাস দীর্ঘদিনের, স্লোভাকিয়ার একমাত্র সিনাগগ দেখা যাবে এখানে, জামোচকা স্ট্রিটে পুরনো বাড়ি ঘর। ওয়ারশ, ফ্রাঙ্কফুর্টের মতন ফেক স্টুডিও সেট নয়।। পাহাড়ের ওপরে আছে প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত দেভিন দুর্গ,স্লোভেনিয়ানরা সেই নামটির অরিজিনালিটি দাবি করেন! নাৎসি জার্মানির কবল থেকে এ শহরকে উদ্ধার করতে প্রাণ দিয়েছিলেন প্রায় সাত হাজার সোভিয়েত সৈনিক, তাঁদের নাম লেখা সমাধিস্তম্ভ আরেক পাহাড়ের ওপরে। পালফি প্যালেস ভেন্তুরসকা স্ট্রিটে পালফি প্যালেস – দুশ বছর আগে সম্রাজ্ঞী মারিয়া থেরেসার জেনারেল লেওপোলড পালফি এটির নির্মাণ করেন। কিংবদন্তি মোতাবেক ১৭৬২ সালে ছ বছরের বালক ভলফগাঙ আমাদেউস মোৎসার্ট এখানে পিয়ানো বাজিয়েছিলেন। পরে পালফি বংশধরেরা ভিয়েনায় আস্তানা গাড়েন। তাদের এক অনেক উত্তর উত্তর পুরুষ,ক্রেডিট আনসটালট ব্যাঙ্কের নিকলশ পালফি আমার দীর্ঘদিনের ব্যবসায়িক সঙ্গী (বৈঠকি আড্ডায় পঞ্চম পর্ব পশ্য)। আমি জিজ্ঞেস করলে নিকলশ অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলেছেন পালফি প্যালেসে মোৎসার্টের পিয়ানো বাজানোর গল্পটি তিনি বাল্যকাল থেকে শুনে এসেছেন। হয়তো পালফি পরিবারের প্রতি প্রজন্মের শিশুদের শুনতে হয়েছে - কিছুই শিখলে না! জানো মোৎসার্ট ছ বছর বয়েসে পিয়ানো বাজিয়েছেন, এই আমাদের পূর্ব পুরুষের বৈঠকখানায়। আর তোমরা? ফুটবল নয় ভিডিও গেম নিয়ে পড়ে আছো! তখন ফোন ক্যামেরা ছিল না,কোন ছবি কেউ এঁকে রাখেন নি, কোন সাক্ষ্য প্রমাণ নেই! বরং পালফি নামটার জন্যই নিকলশ মরমে মরে থাকেন। সে প্যালেস নেই, তিজোরি কবে শূন্য। ব্যাঙ্কে কলম পিষে বা কীবোর্ড পিটে খেতে হয়! আমাদের দেশে আজকাল ইনভেডার কথাটা খুব চালু, সেদিন টেলিভিশনে দেখলাম যোগী আদিত্যনাথ বলছেন ভারতের প্রকৃত পরিচয় তাজমহলে নয়, সনাতন অট্টালিকা ও মন্দিরে। ব্রাতিস্লাভা আজ পরম যত্নে রক্ষা ও পরিচর্যা করে তাদের ইনভেডারদের স্থাপত্য,শিল্পকলা। চলতি কথা আছে একশ দেশের হাতের বা পায়ের চিহ্ন ভরে রেখেছে ব্রাতিস্লাভাকে। দেভিন বা ব্রাতিস্লাভা দুর্গ থেকে আদিগন্ত দেখা যায়,ঐ উজ্জ্বল দিন ডাকে স্বপ্ন রঙ্গিন, দূরে প্রশস্ত প্রসন্ন দানিউব বয়ে যায়। আহা কি চমৎকার এই বেঁচে থাকা। ব্রাতিস্লাভার গলিতে পাব পুরনো শহরের অলিতে গলিতে পাবেন পাব- বড়ো,মাঝারি এবং ছোট। বাইরের সাইনবোর্ড দেখে এমনি কোথাও ঢুকে পড়লে মনে হবে যেন বিনা এত্তেলায় কারো বসবার ঘরে প্রবেশ করেছেন, এমনই অন্তরঙ্গ। ভাষায় আটকাবে না, হলিউড, টেলিভিশন, ইউরোভিশনের দৌলতে ইংরেজি ভাষা আজ যথেষ্ট প্রচলিত যা আমার প্রথম যাত্রায় দেখি নি। স্লোভাক বিয়ার অতি উচ্চ মানের। কোন বিয়ার ? ক্লসটরনি(মঠ মন্দিরের) না স্টারোস্লোভিইয়েনসকি(প্রাচীন স্লোভাক) পিভোভার ? নামের জটিলতায় যাওয়া অর্থহীন,যে কোন সোনালি পানীয় হাতে তুলে নিন (ডুঙ্কেল বা ডার্ক বিয়ার বিশেষ দেখি নি, সেটা আইরিশ বেলজিয়ান ও জার্মানির কলোনের জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া ভালো)। নাম যাই হোক না তার স্বাদ অনবদ্য। পান করলেই মনে হয় সমস্ত ব্রিটিশ বিয়ারকে অতি সত্বর নর্দমায় ঢেলে দেওয়া উচিত। বুঝেছি কেন এ দেশে মাথা পিছু বার্ষিক বিয়ার পানের পরিমাণ জার্মানি ও চেকের সঙ্গে সমান তালে পাল্লা দেয়।বহুকাল আগে নিউ ইয়র্কের বার্নস অ্যান্ড নোবেলের বইয়ের দোকানে চা কফি মেলে সেটা দেখে খুব অবাক হয়েছিলাম; চায়ের দোকানে বইটা অনুষঙ্গ না বইয়ের দোকানে চা? ব্রাতিস্লাভার কোনো পাবে পা দিয়ে মনে হয়েছে এটা হয়তো স্থানীয় পাবলিক লাইব্রেরি। ডজন দুয়েক টেবিল, তাকে ঘিরে নিতান্ত অসংলগ্ন ভাবে দু চারটে করে চেয়ার। টেবিলে ছড়ানো আছে বই;অনেক ভাষায়, কোনো বইয়ের পাতা খোলা,পাশে পেন্সিল। কেউ যেন পড়তে পড়তে উঠে গেছেন,একটু বাদে ফিরবেন। সেখানে বসে যেমন খুশি বই তুলে নিয়ে যতক্ষণ খুশি পড়ার কোন বাধা নেই। কেউ এসে জিজ্ঞেস করবে না আপনি আর কিছু নেবেন কিনা। আপন তৃষ্ণা কখন কিসের জন্য জাগে সেটা যথাস্থানে জানানোটা আপনার কাজ,অযথা আপনাকে বিরক্ত করে সে তথ্য জানতে তাঁরা অনিচ্ছুক।মারেকের অপেক্ষায় বসে ছিলাম, এদিক ওদিক তাকিয়ে একটা বইয়ের দিকে চোখ চলে গেল – ইংরেজিতে লেখা, The Jews of Czechoslovakia,১৯৬০ নাগাদ প্রকাশিত মোটা বাঁধানো বই, আকর গ্রন্থ -উনিশ শতকের ইহুদি সমাজ, চেক সাহিত্য (কাফকা জার্মানে লেখেন কিন্তু মিলেনা ইয়েসেনসকাকে আন্তরিক চিঠি লিখেছেন চেক ভাষায়) অর্থনীতি,সংগীত, চিত্রকলা নিয়ে একটি পাঁচশ পাতার রিসার্চ পেপার, পাতায় পাতায় সুন্দর হাতে লেখা নোট! প্রামাণ্য রেফারেন্স বই, কেবল লাইব্রেরিতে প্রাপ্য। আমাকে তাতে মগ্ন দেখে আধ লিটারের বিয়ার মাগ টেবিলে দিতে এসে বার কিপার বললেন,রাখবেন বইটা? আমি খুব অবাক হয়ে বললাম, না মানে, এই পাতা ওলটাচ্ছিলাম আর কি। তিনি হেসে বললেন, নিয়ে যান, এটা আপনাকে উপহার দিলাম! উপহার পাওয়া The Jews of Czechoslovakia *ভ্লাদিমির ক্লেমেন্তিস তখন চেকোস্লোভাকিয়ার বিদেশ মন্ত্রী ছিলেন। যুদ্ধের পরে কমিউনিস্ট প্রশাসনে আবার বিদেশ দফতর সামলান কিন্তু স্টালিনেরর রোষানলে পড়েন। তাঁকে প্রতিক্রিয়াশীল ও বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী দাগিয়ে দিয়ে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। ক্রমশ...
  • হরিদাস পালেরা...
    ভোটুৎসবে ভাট-কে তুমি তন্দ্রাহরণী? - সমরেশ মুখার্জী | অনেকক্ষণ ব‌ই পড়লে, ল‍্যাপটপে ভিডিও দেখলে আমার চক্ষুদুটি কিঞ্চি প‍্যাঁ-প‍্যাঁ করে ওঠে। চোখ 'প‍্যাঁ-প‍্যাঁ' করা আমাদের পুত্রদেবের শিশুবেলায় ভোকাবুলারি। এমন কিছু ইউনিক শব্দসৃষ্টি অনেক শিশু‌ই করে থাকে। আজন্ম কলকাতার বাইরে বড় হয়ে, দেরিতে কথা ফুটে, যুক্তাক্ষরে হোঁচট খেয়ে মনোভাব প্রকাশের তাগিদে সে ছোটবেলায় এমন সব বিচিত্র শব্দ সৃষ্টি করেছিলো। চোখ 'প‍্যাঁ-প‍্যাঁ' করিতেছের নির্গলিতার্থ - ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে।       আরেকটা মজার উদাহরণ নেওয়া যাক। সন্ধেবেলায় জামনগরে লাখোটা লেকের ধারে বাজারে গেছি তিনজনে। বৌ হঠাৎ কনুই দিয়ে ঠোনা মারে। শুধোই, কী হোলো? কানে কানে বলে বৌ, ওর হিসি পেয়েছে বলছে। বাড়িতে তো - বমি থেকে বাহ‍্যে - শিশুদের সব দায়িত্ব‌ মায়েদের। তবে ছেলেটা‌ তো আর বাণের জলে ভেসে আসেনি। তার ধরায় আগমন আমাদের জয়েন্ট ভেঞ্চার। তাই বাইরে বেরোলে তাকে হিসু করানোর দায়িত্ব আমি স্বেচ্ছায় পালন করতাম। তাই তার ড‍্যানা ধরে নিয়ে গেলুম একটা নর্দমার ধারে। ছেলের পেছনে দাঁড়িয়ে, কোমর ঝুঁকিয়ে, হাফ প‍্যান্টের জিপ খুলে, দু আঙ্গুলে ঐটি ধরে, মুখে - সিইইই, সিইইই আওয়াজ করি।        ইলিউসিভ 'অচ্ছে দিনের' মতো আমার মুখে সিসি‌ই সার - হিসি আর আসেনা। কোমর ব‍্যাথা করছে। ছেলে আমার দু আঙ্গুলে তার মহার্ঘ সম্পদ নির্দ্বিধায় সমর্পন করে ভাবলেশহীন মুখে দাঁড়িয়ে। কী হলো রে? হিসি পেয়েছে বললি যে? জানতে চাই আমি। ছেলে করুণ গলায় বলে, পেয়েছিলো তো, এখন আসছে না। আর একটু দাঁড়াও, 'চেষ' করে দেখি। অর্থাৎ যেটা তখন ওর আসছে মনে হয়েছিল, করতে গিয়ে দেখা গেল ছলনা, তাই আর একটু চেষ্টা বা ওর ভাষায় - 'চেষ' করতে চায়। তবে শুধু শিশু‌ নয়, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বা চাষী‌র দ্বিগুণ আয়ের জন‍্য নিবেদিত‌প্রাণ দেশসেবকরাও অহোরাত্র 'চেষ' করে চলছেন। কাঙ্ক্ষিত ফল এলো বলে।    শিরোনামে‌র প্রসঙ্গটি ২০১৮ সালের। তখন আমাদের একমাত্র পুত্র মনিপাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। অসময়ে কর্মজীবনে অবসর নিয়ে আমরা তিনজন ওখানে একটি চারশো ফ্ল‍্যাটে‌র  হাউসিং সোসাইটি‌তে একটা বড় দ্বিশ‍্যয‍্যার ফ্ল‍্যাট ভাড়া নিয়ে ছিলাম। ছেলে হোস্টেল ছেড়ে আমাদের সাথে‌ই থাকে। সেই ফ্ল‍্যাটে‌র কিচেন বারো বাই বারো। আঠারো বাই চোদ্দ ড্রয়িং রুমে টেবল টেনিস খেলা যায়। দুটো বেডরুমে বাড়ি‌ওলার দুটো ডাবল বেড পাতা আছে। ভাইনিং স্পেসে দে‌ওয়াল সাঁটিয়ে ডাইনিং টেবল রেখে‌ও যে জায়গা ছিল সেখানে‌ পেতেছি আমাদের ডাবল বেড খাট।      ওটা বারোয়ারী খাট। এই খাটের মাথার দিকে আছে কিছু না পড়া ব‌ই। অন‍্য দিকে পড়া কাগজের ডাঁ‌ই।  আছে ইস্ত্রি করতে যাওয়ার জন‍্য ব‍্যাগে জমা করা কাচা কাপড়ে‌র ডাঁ‌ই, রোল করা যোগা ম‍্যাট একটা, জলের বোতল কয়েকটি, দুটো ছাতা। এককোনে শুয়ে আছে দুটো রোগা ডাম্বেল। তলানি বাহুবল টিকিয়ে রাখতে কখনো একটু ভাঁজি। পাশে একটা টামি ট্রিমার। ইচ্ছে হলে পা ছড়িয়ে বসে একটু রোয়িং করি। বৌ ঐ খাটে ফ‍্যানের তলায় বসে খবরের কাগজ পেতে সবজি কাটে। এহেন নানাবিধ কাজকর্ম হয় ঐ খাটে।     দেওয়ালে প্লাস্টিক ইমালশন, তাতে ঝুলছে দূর্বোধ‍্য ছবি, নিয়মিত ডাস্টিং করা ঝাঁ চকচকে আসবাব, ওয়াল ক‍্যাবিনেটের মাঝে ৫৬ ইঞ্চি এল‌ইডি টিভি, দুপাশে দাঁড়িয়ে লম্বা কানের জিরাফকন্ঠী  বাঁকুড়ার বিখ্যাত ঘোড়া .... এমন মিউজিয়াম সদৃশ বাড়িতে থাকতে আমার দমবন্ধ লাগে। এমন বাড়ির ফুলকাটা ফলস্ সিলিংয়ে মাকড়সা‌ও পেটে ডিম নিয়ে চারদিকে আটপায়ে দৌড়ে মরে ভাগ‍্যকে গাল পাড়ে - কেন যে মরতে ঢুকেছিলাম এ বাড়িতে! এখন নেক্সট জালটা কোথায় পাতি রে বাবা! প্রতি হপ্তায় তো ভ‍্যাকুয়াম ক্লীনার দিয়ে আপদ চাকরটা শোঁক শোঁক করে টেনে নেয় সব জাল। এদিকে লালা তো শুকিয়ে কাঠ!     প্রাচীন বনেদী বাড়ি‌র রঙচটা বিশ ইঞ্চি দেয়ালে কুলুঙ্গির কোনে ফুরিয়ে আসা ড্রিমফ্লাওয়ার ট‍্যাল্কের গোলাপী লম্বাটে কৌটো, খিলান ওয়ালা বড় দালান, খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে চড়াইয়ের অবাধ আনাগোনা, উঁচু কড়ি বরগার ছাদ‌, তার ফাঁক ফোঁকরে রোমান্টিক পারাবত প্রিয়ার জুটি ... এসবের একটা মিস্টিক  নস্টালজিক এসেন্স আছে।     কখনো মধ‍্যবিত্ত বাড়ি‌তেও পাওয়া যায় অন‍্য আর এক ধরণের মিস্টিক চার্ম। ঠাকুরদার আমলের পালিশ‌ওঠা ভারী মেহগনি খাট যা সরাতে চারজন লাগে। ছতরির কোনে তাল পাকানো তালি মারা মশারি। দেওয়ালে স্মৃতি‌চিহ্ন হয়ে ঝুলছে বন্ধ হয়ে যা‌ওয়া কুক এ্যান্ড কেলভি গ্ৰ‍্যান্ডফাদার ক্লক। পাশে ঠাকুমার কারুকার্য‌ময় বার্মাটিকের আলমারি। তার পাশে আলনা। সিলিং থেকে ঝুলন্ত ও আজ‌ও ঘূর্ণায়মান নব্বই বছরের হেরিটেজ ফ‍্যান - 'জিইসি তুফান' - কাঠের চার ব্লেডের সেই ডিসি ফ‍্যান এখন কন্ভার্টার দিয়ে এসিতে চলে। কি হাওয়া! এসব উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। এর সাথে জড়িয়ে থাকে বহু মধূর স্মৃতি। একটু দুরে মূর্তিমান কন্ট্রাস্ট। হাল আমলের ফঙ্গবেনে ডাইনিং টেবিল ও চেয়ারের সেট। ঐতিহ‍্যময় অতীত ও পানসে বর্তমানের কোলাজ। আমার  মন্দ লাগে না এমন বাড়িতেও। মাটির কিছুটা কাছাকাছি মনে হয় নিজের অস্তিত্ব। শেষবেশ ওতেই তো মিলতে হবে। তাই যদ্দিন বাঁচি ফুটপাতে‌র ধুলো বাঁচিয়ে‌ কিঞ্চিৎ ওপরে থেকে যতটা পারি মাটির গন্ধে আঁচা‌ই। ওপারে যাওয়ার আগে‌ খুব বেশি ওপরে ওঠা‌র সাধ নেই। সাধ‍্য‌ও নেই।    তবে চতুর্দিকে প্রাণে ধরে ফেলতে না পারা নানা অপ্রয়োজনীয় বস্তুর ডাঁই, দেওয়ালে পুরোনো ক‍্যালেন্ডার, দেওয়ালের কোনে ঝুল, খাটের তলায় আবর্জনা, চিমসে গন্ধ - এমন বাড়ি‌ও ভালো লাগে না।      কড়ে আঙুলের টোকায় স্ফটিকের ফুলদানি উল্টে যাওয়ার ভয়ে সিঁটিয়ে থাকার মতো টিপটপ ড্রয়িং রুমের চেয়ে আমার পরিচ্ছন্ন কিন্তু একটু আগোছালো ঘরে থাকতে বেশ লাগে। দীপাবলীর আগে দোকান ঝাড়পোঁছ করার মতো হয় কেউ আসার হলে তার আগে ঘরদোর ভালো করে গোছগাছ হয়। অতিথি চলে গেলে ঘরদোর আবার যে কে সেই - ভোটের পরে রাস্তার মতো।  আমার চোখ 'প‍্যাঁ-প‍্যাঁ'  সিনড্রোম যে কোনো সময় হতে পারে। তখন চোখে দু ফোঁটা আইটোন দিয়ে ধপাস করে ডাইনিং‌ স্পেসের ঐ বারোয়ারী খাটে টুকুন বডি ফেলার স্বর্গ‌সুখ আমার মতো অলস সম্প্রদায়ের অকোজো ঢেঁকি ছাড়া অন‍্য কেউ বুঝবে না।    ছেলের কলেজ কাছেই। দুপুর খেতে আসে। খেয়ে আবার কলেজে যায়। ফেরার নির্দিষ্ট সময় নেই। কখনো পাঁচটায় চলে আসে। লাইব্রেরী‌তে গেলে দেরি হয়। তাই আমি সদর দরজায় ছিটকিনি দি‌ই না। ওকে বলেছি বেল বাজিয়ে ঘুম ভাঙ্গাবি না। ইয়েল লকের হ‍্যান্ডেল ঘুরিয়ে দেখবি আগে। দরজা বন্ধ থাকলে তবেই বেল দিবি। ছেলে বলে, তুমি যেভাবে সী বীচে ভেসে এসে আটকে যাওয়া জেলিফিশের মতো খাটে পড়ে অঘোরে ঘুমো‌ও, একদিন দেখবে কেউ ঢুকে ল‍্যাপটপ, মোবাইল নিয়ে পালিয়ে যাবে। আমি বলি, বাজে বকিস না। গেটে সিকিউরিটি, চারদিকে সিসি ক‍্যামেরা, ক‍্যূরিয়ার, আমাজন, জোমাটো, সুইগির ছেলেগুলো‌কেও খাতায় স‌ই করে ঢুকতে হয়। এটা কলকাতা নয়, এখানে ওসব হবে না। তাই ঐ অবস্থা‌ই জারি আছে। ও বেল না বাজিয়ে ঘরে ঢোকে। তাই এখন বেল বাজে কেবল ক‍্যূরিয়ার বা গ‍্যাস এলে।     সেদিন বেলা চারটে অবধি মোবাইলে শব্দের গামছা বুনে চোখটা 'প‍্যাঁ-প‍্যাঁ' করে উঠলো। পত্রপাঠ সেই খাটে ধপাস। খানিক বাদেই বেশ মিঠে একটা তন্দ্রা মতন এসেছিল তখনই - ডিং ডং। কী ব‍্যাপার? দরজা‌তো খোলা। গ‍্যাস‌ও আসার নেই। তবে কি ক‍্যূরিয়ার? বাড়িতে বারমুডা পরে খালি গায়ে থাকি। বড় আরাম। ছেলের বন্ধু‌রা আসার থাকলে ছেলে‌ই আগাম ফোন করে জানায়, বাবাই আমার সাথে শ্রীজা আর দিন্দু আসছে, গায়ে জামা দাও। তখন দিতে হয়। এখন আবার কে এলো?     কাঁচা ঘুম ভাঙ্গা আঠালো চোখে গায়ে একটা গামছা ফেলে বাইরের দরজা খুলি। চাচী ৪২০ গোছের এক স্থানীয় মহিলা বাইরে দাঁড়িয়ে। চাপা রঙ, মধ‍্য বয়স, জাঁদরেল চেহারা। ঘুম চোখেও বুঝতে পারি তিনি ভুল দরজায় বেল বাজিয়ে ফেলেছেন। এমন অনেকবার হয়েছে। শনিবার রাত দুটোয় কারুর ঘরে পার্টি থেকে কোনো কারণে বেরিয়ে পুনরায় ফেরায় সময় কেউ বন্ধু‌র ফ্লোর গুলি‌য়ে ফেলে আমাদের ফ্ল‍্যাটের বেল বাজিয়েছে। আমায় দরজা খুলতে দেখে সোমরসে চুরচুর বালক ''সরি আঙ্কল, সরি আঙ্কল' বলতে বলতে পালিয়ে গেছে। বা ফ্ল্যাট নম্বর ভুল দেখে ফুড ডেলিভারি দিতে এসে আমাদের ফ্ল‍্যাটের বেল বাজিয়েছে। এসব ক্ষেত্রে তাদের প্রথম প্রতিক্রিয়া হয় দরজার ওপরে লেখা ফ্ল্যাট নম্বর মিলিয়ে দেখা।     মুখে নীরব প্রশ্ন মাখিয়ে মহিলা‌র দিকে তাকাই। তিনি কিন্তু দরজার ওপরে ফ্ল‍্যাটের নম্বর না দেখে আমাকে‌ই খুঁটিয়ে দেখতে থাকেন। হয়তো ভাবেন ফ্ল্যাট তো এটাই মনে হচ্ছে, তাহলে হয়তো কাজের লোক বদল হয়ে গেছে। গায়ে গামছা, না কামানো দাড়ি, হাফ প‍্যান্ট পরিহিত আমায় দেখে তেমন ভাবলে তাকে দোষ দেওয়া‌ও যায় না। কিন্তু মুখে কিছু জিজ্ঞাসা‌ও তো করে মানুষ। তাও না। আধখোলা দরজার ফাঁক দিয়ে তিনি মুখ গলিয়ে বাঁদিকে তাকান। একটা বড় কার্টনে ভরা আছে সবার কচিৎ ব‍্যবহারে‌র জুতো। তার পাশে আগের ভাড়াটের ফেলে যাওয়া বেতের জুতোর র‍্যাক। এতক্ষনে চাচীর মুখে একটু অপ্রস্তুত হাসি ফোটে। অর্থাৎ, দোষ নিওনি কত্তা, টুকুন ভুল হয়ে গেছে। তিনি কিছু না বলে চলে যান।   আমি চিন্তিত মুখে দরজা বন্ধ করতে করতে ভাবি, ঘরের নম্বর নয়, বাড়ির কর্তাকে কাজের লোক ভেবেও নয় -  জুতোর র‍্যাক দেখে বুঝতে হলো ফ্ল‍্যাটটা ভুল? আশ্চর্য!
    বিপথে ভোট রাজনীতি - Bhattacharjyo Debjit | "আমার মরদ বিয়ের সময় নেয় পঞ্চাশ হাজার টাকা নগদ। বিয়ের দুদিন পর থেকে গা'য়ে হাত তোলা শুরু করে। ধীরে ধীরে ওর বাড়ির লোকও আমার গায়ে হাত তোলে। ওরা আমাকে ঠিকভাবে খেতে দিত না। কারোর সাথে কথা বললে সন্দেহ করতো। ঘরে বন্দী করে রাখতো সারাদিন। আর কাজ করাতো। এই অসহ্য নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে এখন আমি শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি। ওদের নামে আদালতে মামলা করেছি। উকিলের পরামর্শে শ্রীরামপুর ওমেন্স থানাতে গিয়েও এফআইআর(৮.৪.২০২৪) করেছি। পুলিশ জানালো, 'ভোটের আগে কিছু হবে না'। ওদের পরিবার এখন আমাকে শাসকদলের এক আঞ্চলিক নেতার ভয় দেখিয়ে খুন করার হুমকি দিচ্ছে। আমি এখন কোথায় যাই, কী করি?"এ বয়ান এক সংখ্যালঘু পরিবারের চটকল শ্রমিকের সদ্য বিবাহিতা উনিশ বছরের মেয়ের। সে আশা করে ছিল, বিচার পাবে খুব শীঘ্রই। পুলিশ গ্রেফতার করবে অপরাধীদের। কিন্তু সে পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো ভোট, শাসকশ্রেনীর ভোট-রাজনীতি। এরপর, সেই মেয়ে পাড়ার শাসক-বিরোধী উভয়দলের সঙ্গে দেখা করে, সেখানেও কোনরকম সু-বিচারের আশা মেলেনি। ভোট রাজনীতির চাপে কেউ নির্যাতিতা মেয়ের পুরো কথা শোনার সময়টুকু পাননি। অবশেষে উকিল জানালেন, ভোটের আগে কিছু হওয়া সম্ভব নয়। অভিযোগ, মেয়েটির শ্বশুরবাড়ির লোকেরা শাসকদলের আঞ্চলিক নেতার ঘনিষ্ট।আজ এমন অবস্থা কেবল এই ছোট মেয়েটির তা নয়। রাজ্যে বিভিন্ন প্রান্তে নির্যাতন-অত্যাচারের শিকার মেয়েরা, শ্রমজীবী মায়েরা। এর থেকেও ভয়ংকর ফ্যাক্টর, এখনের রাজ্য-রাজনীতির পরিবেশ। এই রোমহর্ষক ঘটনাগুলি ধরে শাসক-বিরোধী প্রতিটি দলের প্রত্যহ নিয়মতান্ত্রিক নোংরা ভোট রাজনৈতিক অনুশীলন। এ রাজ্যে শেষ এবং সব থেকে বড় ঘটনা সন্দেশখালি। সামনে এসেছে শাসকদলের নেতাদের একের পর এক কুকীর্তি। যেখানকার নির্যাতিতা মেয়েদের জমি, শ্রমশক্তি লুঠের সুবিচারের প্রহসনের আদলে শাসকশ্রেনীর অস্ত্র অতীব নিম্নমানের কুৎসিত ভোট রাজনীতি। যার থেকে নিঃসন্দেহে ইঙ্গিত মেলে এ সমাজ বিপথে চালিত হওয়ার। এই সমাজের নোংরা রাজনৈতিক সংস্কৃতির শিকার রাজ্যের সিংহভাগ শ্রমিকেরা। যাঁদের ন্যূনতম রাজনৈতিক-গণতান্ত্রিক অধিকারগুলি হরণ হয় প্রতিদিন। এবারের ত্রিপাক্ষিক চুক্তিতে(৩রা জানুয়ারি ২০২৪) 'কাজের বোঝা' বেড়ে যাওয়া ও মজুরি কমে যাওয়াকে কেন্দ্র করে অধিকাংশ চটকলগুলি শ্রমিক বিক্ষোভের সম্মুখীন। ফলে, মালিকপক্ষ বিক্ষোভকারী শ্রমিকদের দাওয়াই দিতে 'গেট বাহির' করছেন। বজ্জাত শ্রমিককে ছাঁটাই করতে ঘনঘন 'ডোমেস্টিক এনকোয়ারি' বসিয়েছেন। শ্রমিকেরা কাজের আশায় ছুটছেন, থানা, ডিএলসি, শাসক-বিরোধী দুই পক্ষের দুয়ারে। শ্রমিকের কথা শাসকের শোনবার সময় নেই। আর, বিরোধী রাজনৈতিক দল শ্রমিকের কথা শুনে, এক এক জনের খুলি ধরে ভোটের অঙ্ক কষতে ব্যস্ত। আশ্বাস, তাঁদের দলের এমপি এবারেও মন্ত্রী হয়ে ফিরে এলে শ্রমিকেরা কাজ পাবেন, চটকলের সমস্যা ঠিক হয়ে যাবে। অথচ, সেই রাজনৈতিক দলের এমপিদের চটকল চত্বরে গত পাঁচ বছরে দেখা মেলেনি। পুলিশ-প্রশাসন ঘুরিয়ে নাক ধরবার নিদানে হুঁশিয়ারি দেন শ্রমিককে, ভোটের আগে কোনরকম আন্দোলনে না যাওয়ার। একদিন কাজ না পেলে শ্রমিকের ঘরের উনুনে আগুন জ্বলে না, একথা কারোর অজানা নয়। পরিবারের ছয় থেকে আটটা চোখ ড্যাব-ড্যাব করে চেয়ে থাকে একজনের মুখের দিকে, সে-ই হল চটকলের শ্রমিক, সংসারের প্রথম এবং শেষ রোজগারের ব্যক্তি। যাঁদের ভোট শেষ হওয়ার অপেক্ষায় ধৈর্য্য ধরে বসে থাকবার উপায় নেই! এমনই বিপথে ভোট রাজনীতি, সমাজ - যেখানে নির্যাতিতা মেয়ে, শ্রমিকের ন্যূনতম রাজনৈতিক-গণতান্ত্রিক, মৌলিক অধিকারগুলি রক্ষার কোন রক্ষাকর্তা নেই। নেতা, সমাজের রক্ষা-কর্তারা সামগ্রিকভাবে বুঝিয়ে দেন, আগে ভোট পরে অধিকার, আগে ভোটের রাজনীতি পরে সামাজিক সুবিচার। এ বিষয়ে শ্রমিক সংগঠনগুলিও আজ প্রশ্নহীন। এর ফলে ক্ষতি আখেরে কার, কেবলই সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের? রাজনৈতিক দলগুলির কী নয়? এবারের তিন দফা ভোট অতিক্রান্ত। প্রথম দফায় ভোট পড়েছে, ৮১.৯১ শতাংশ যা ২০১৯ সালের লোকসভার থেকে ২.৮৮ শতাংশ কম (জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার)। দ্বিতীয় দফায় ৪.০৪ শতাংশ কম। দুই দফার পরে বিভিন্ন রাজনৈতিকদল, নির্বাচন কমিশনের তরফ থেকে অনুমান করা হয়েছিল, গরমের কারণে ভোট দিতে আসছে না বহু সাধারণ মানুষ। তাই নির্বাচন কমিশনের তরফ থেকে তৃতীয় দফায় প্রত্যেক ভোট কেন্দ্রে জল, ওআরএস, ভোটারদের মাথার উপরে ছায়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তার পরেও তৃতীয় দফায় গড়ে পাঁচ শতাংশ ভোট কম পড়েছে(মালদা উত্তর, মালদা দক্ষিণ, জঙ্গিপুর, মুর্শিদাবাদ মিলিয়ে), মোট দুই লক্ষ তিরানব্বই হাজার ভোটারের অনুপস্থিতি। অর্থাৎ মূল ক্ষতি রাজনৈতিক দলগুলির, এ সমাজের। এ নিয়ে নির্বাচন কমিশন জানালেন, দুটি কারণ; এক, রাজ্যের অনেক পরিযায়ী শ্রমিকেরা ভোট দিতে আসেননি। দুই, নির্বাচনের প্রতি সাধারণ মানুষের অনীহা ক্রমশ বাড়ছে।এত বছর ধরে ভোটের আগে নেতা-মন্ত্রীদের আশ্বাস, প্রতিশ্রুতি ও ভোটের পরে ন্যূনতম অধিকারগুলি হারানোর গোলক ধাঁধায় চক্কর খেয়ে মানুষ আজ ক্লান্ত। বর্তমানে রাজনৈতিক দলগুলির রাজনৈতিক সাংস্কৃতি, রাজনৈতিক প্রচারের হিসেব-নিকেশ দেখে ভোট দিয়ে পরিবর্তনের আশা ক্রমাগত হারিয়ে ফেলছে মানুষ। তবে এই নির্বাচনে কেবল ভোটের হার কমছে যে, এমনটা নয়। 'নতুন ভারত'-এর অষ্টাদশ লোকসভার সময়ে এসেও গ্রামে বিদ্যুৎ না থাকা, রাস্তা তৈরি না হওয়া, জল না আসায় পূর্ব মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর, মালদা জেলার কয়েকটি গ্রামের বহু শ্রমজীবী-কৃষিজীবী মানুষেরা একত্রিত হয়ে এবারের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহন না করবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, 'ভোট বয়কটে'র ডাক দিয়েছেন।আজ শাসক-বিরোধী দলগুলির ভোট রাজনীতি সমাজের একটি অংশের মানুষের জন্যে মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে, যাঁদের আছে ভুরিভুরি সম্পত্তি। তাই শাসকশ্রেণীর রাজনীতিতে সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের জীবনমানের ন্যূনতম উন্নতির কথাগুলিও হারিয়ে যেতে বসেছে। শাসক-বিরোধী দুই পক্ষই এখন 'লাভজনক' রাজনৈতিক এজেন্ডার বাইরে যেতে নারাজ। তাই তাঁদের রাজনৈতিক প্রচারের মুখ্যে স্থায়ী রুজি-রুটির কথা নেই, যা সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের মনে এক প্রকারের রাজনৈতিক শূন্যতার সৃষ্টি করছে। ফলে 'সর্ববৃহৎ গনতান্ত্রিক' এ দেশে বিপথে ভোট রাজনীতি, এ সমাজ। এর শেষ কোথায়? কংগ্রেস নেতা নভোজ্যৎ সিং সিধু গতবছর একটি জনসভা থেকে বিজেপি সরকারের দেওয়া ভুয়ো প্রতিশ্রুতিগুলিকে আক্রমন করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি'র উদ্দ্যেশে বলেছিলেন, "আবকি বার! বাস কার ইয়ার!" আগামীতে এ কথা প্রতিটি রাজনৈতিকদলকে শুনতে হবে নাতো? মানুষের মন কিন্তু সমস্ত হিসেব কড়ায়গন্ডায় গুছিয়ে রাখবার আলমারি।
    টাইটানিক - ডুবেছিল কেন?  - সুকান্ত ঘোষ |  সে প্রায় ১১২ বছর হতে চলল, ১৯১২ সালের ১২ এপ্রিল ইংল্যান্ডের সাউথহ্যাম্পটন থেকে আমেরিকার নিউ ইয়র্কের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছিল ‘রয়েল মেল শিপ (আর এম এস) টাইটানিক’।  সেই সময়ের সবচেয়ে জমকালো জাহাজের যাতার স্থায়ী হয়েছিল মাত্র দুই দিনের মত।  ১৪ই এপ্রিল রাত ১১.৪০ নাগাদ টাইটানিক প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার/ঘন্টা গতিবেগে গিয়ে ধাক্কা দিল এক বিরাট হিমশৈল-তে যার ওজন ছিল দেড় লক্ষ থেকে তিন লক্ষ টনের মত।  তারপর মাত্র দুই ঘন্টা চল্লিশ মিনিট – তার মধ্যেই উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরে ডুবে গেল সেই সময়ের বিষ্ময়ের প্রতীক টাইটানিক।  জলের তাপমাত্রা তখন খুবই কম, চার ডিগ্রীর মত।  বিজ্ঞান বলে এই তাপমাত্রায় মানুষের ২০ থেকে ৩০ মিনিটের বেশী বেঁচে থাকা সম্ভব নয়।  টাইটানিকে যাত্রী ছিল ২০০০ এর কাছাকাছি, এর মধ্যে সেই দিন মারা গিয়েছিল প্রায় ১৫০০ এর মত – এবং বেশীর ভাগই প্রবল ঠান্ডা জলে থাকার ফলে।  মানে মৃত্যু সেই অর্থে জলে ডুবে ঠিক নয়।তবে এ আর নতুন কথা কি! টাইটানিক নিয়ে এত লেখা লিখি হয়েছে যে বলার নয় – বই, প্রবন্ধ থেকে শুরু করে আজকের দিনের ইউ-টিউবের ভিডিও সব ভর্তি।  আর সেই সব কেউ না পড়লেও ১৯৯৭ সালের ‘টাইটানিক’ সিনেমাটি দেখেনি এমন কেউ নেট সার্ফ করছে ভাবাই অসম্ভব আজকের দিনে! মানে এটা বলতে চাইছি টাইটানিক নিয়ে পড়াশুনা করতে চাইলে তথ্যের অভাব নেই।  তবে সব লেখাই কি ঠিক? আর সবার ইন্টারেষ্টও যে টাইটানিকের সব বিষয় নিয়ে থাকবে এমন কোন কথা নেই! এই যেমন আমার উৎসাহ টাইটানিক যে স্টিল বানানো হয়েছিল আর টাইটানিকের ডুবে যাওয়া থেকে আমরা কি কি শিখেছিলাম সেই নিয়ে মূলত। আচ্ছা, টাইটানিকের ডুবে যাওয়া থেকে আমরা অনেক কিছু শিখেছিলাম – এর মধ্যে একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ জিনিস ছিল অমন বিরাট জাহাজের ডিজাইন।  তার পর ছিল, লাইফ বোট কেমন ভাবে রাখতে হবে, কি সংখ্যায় – এমারজেন্সী ইভাক্যুয়েশন কেমন ভাবে হওয়া উচিত, নেভিগেশন সিষ্টেমের উন্নতি – আরো অনেক অনেক কিছু। সেই সব নিয়ে লেখাই যায় – হয়ত পরের পর্বে লিখব।  আজকে লেখা যাক, আমরা যারা ধাতুবিদ, তারা ঠিক কি শিখেছিলাম এই টাইটানিক ডুবে যাওয়া থেকে।   যেটা হয় কিছু ভেঙেচুরে গেলে – প্রথমেই মনে আসে, জিনিসটা ঠিক ঠাক মেটিরিয়াল দিয়ে বানানো হয়েছিল তো? টাইটানিক দূর্ঘটনার পর স্বভাবিক ভাবেই পাবলিকের মনে এসেছিল যে নির্ঘাত আয়ারল্যান্ডের জাহাজ বানানোর কোম্পানী ‘হারল্যান্ড অ্যান্ড উলফ’ টাকা পয়সা বাঁচাতে ফালতু স্টিল দিয়ে টাইটানিক বানিয়েছিল।  টাইটানিক আদপে ছিল ‘হোয়াইট স্টার লাইন’ কোম্পানীর – এবং শুধু টাইটানিক নয়, একই সময়ে এরা ‘হারল্যান্ড অ্যান্ড উলফ’ কোম্পানীকে বরাত দিয়েছিল আরো দুটো একই সাইজের জাহাজ বানাবার।  টাইটানিক খুব বেশী জমকালো ইন্টিরিয়ার ডিজাইন ইত্যাদিতে ভরা হলেও সাইজের দিক থেকে এই তিনটি জাহাজ ছিল একই রকম – তাই এদের বলা হত থ্রী সিসস্টার্স।  আর এম এস টাইটানিক, আর এম এস অলেম্পিক এবং আর এম এস জাইগ্যান্টিক।  যত দিনে জাইগ্যান্টিক বানানো শুরু হয়, তত দিনে টাইটানিকের দূর্ঘটনা ঘটে গ্যাছে – শুধু জাইগ্যান্টিকের ডিজাইনের কিছু অদল বদল করা হল তাই নয়, নামও পালটে রাখা হল আর এম এস ব্রিটানিক।আগেই বলেছি আমার নিজের ইন্টারেষ্ট ছিল এই টাইটানিক বানানোর স্টিল নিয়ে।  আর আগের আর একটা প্রশ্নের জবার আগে থেকেই লিখে রাখি – টাইটানিক ডুবে যাবার পর গবেষণা করে দেখা গ্যাছে ‘হারল্যান্ড অ্যান্ড উলফ’ কোম্পানী বাজারের খারাপ স্টিল দিয়ে সেই জাহাজ বানায় নি, মানে কোন শর্ট-কার্ট নেয় নি।  সেই সময়ে যে স্টিল দিয়ে জাহাজ বানানো হত – সেই স্টেট অব দ্যা আর্ট স্টিল দিয়েই বানানো হয়েছিল টাইটানিক।  টাইটানিকের জলে ভাসার স্থায়িত্ব সপ্তাহ খানেক (বেলফাষ্টের কারখান থেকে ইংল্যান্ডে আসা এবং তারপর আমেরিকা যাবার সময় মিলিয়ে) হলেও তার সহোদরা জাহাজ অলেম্পিক ইংল্যান্ডের সাউথহ্যাম্পটন থেকে আমেরিকার নিউ ইয়র্কের মধ্যে ৫০০ বার রাউন্ড ট্রিপ মেরেছিল ১৯৩৫ সালে অবসর নেবার আগে।  অন্য বোন ব্রিটানিক অবশ্য খারাপ ভাগ্যের মধ্যে দিয়ে গিয়েছিল – ব্রিটানিক বাজারে আসার কিছুদিন পরেই প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ লেগে যায়।  ব্রিটানিক-কে যাত্রীবাহী জাহাজ থেকে পরিণত করা হল এক জাহাজ হাসপাতালে। বেশ চলছিল, কিন্তু ১৯১৬ সালে গ্রীসের কাছ দিয়ে যাবার সময় একটা মাইনের বিস্ফোরণ আঘাত করে জাহাজকে।  ৫০ মিনিটের মধ্যে ডুবে যায় জাহাজটি – তবে খুব কম মানুষই মারা গিয়েছিল।তাহলে কি দেখা গেল? টাইটানিকের খারাপ ভাগ্য বলতে ওই একটাই – ভেসে আসা হিমশৈল! তার সাথে ধাক্কা না খেলে টাইটানিক ওর বোন অলেম্পিক এবং আরো অনেক জাহাজের মতই বার্ধক্যে প্রবেশ করেই অবসর নিত।  ভুল সময়ে ভুল জায়গায় থাকাই টাইটানিকের কাল হয়েছিল!তাহলে ধাতুবিদরা কি শিখেছিল এই টাইটানিক ডুবে যাওয়া থেকে? ধাতুবিদরা একটা বিষয় নিয়ে আগে নাড়াচাড়া করলেও, তেমন ভাবে ডিজাইনে এর মর্ম বুঝে উঠতে পারে নি – সেটা হল, তাপমাত্রা কমে যাবার সাথে সাথে ধাতুর ব্যবহারের পরিবর্তন – মূলত তার মেকানিক্যাল ধর্মসমূহ।  বেশীর ভাগ ধাতুই, বিশেষ করে ইস্পাতের তাপমাত্রা যদি আপনি ক্রমশ কমিয়ে আনতে থাকেন, তাহলে দেখবেন একটা তাপমাত্রার পর খুব দ্রুত ভাবে ইস্পাতের যে নমনীয়তা তা কমে গিয়ে ইস্পাত ভঙ্গুর হয়ে যাবে।  ইস্পাতের এই ধর্ম-কে বলে ‘নমনীয়-ভঙ্গুর পরিবর্তন’।  এবার বুঝতেই পারছেন, আমরা চাইব এই পরিবর্তনের তাপমাত্রা যতটা কম হয় ততটা।  মানে ধরুণ যদি কোন ভাবে এই ট্রানজিশন তাপমাত্রা ১৮ ডিগ্রীর মতন হয়, তাহলে কলকাতার শীতকালে হাওড়া ব্রীজের অবস্থা টালমাটাল – টাইটানিক মত কেস হতেও দেরী হবে না যদি কেউ একটা ধাক্কা দেয়!  বিশেষ পদ্ধতিতে স্টিল বানিয়ে, বিশেষ কিছু পদার্থ স্টীলে যোগ করে এই  ট্রানজিশন  তাপমাত্রা করানো হয়।  আমাদের সৌভাগ্য যে এই সব তত্ত্ব না জানার আগেও, একদম ফালতু পদ্ধতিতে বানানো ইস্পাতেরও ট্রানজিশন তাপমাত্রা ১৮ ডিগ্রীর কম হয়।  কিন্তু কত কম?  টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ থেকে কিছু টুকরো টাকরা উদ্ধার করে অ্যানালিলিস করা হয়েছে। এবং সেই টাইটানিক বানানোর ইস্পাতের সাথে আজকের দিনে যে ইস্পাত দিয়ে জাহাজ বানানো হয় তার তুলনা করা হয়েছে।  দেখা গ্যাছে যে কিছু জিনিস টাইটানিকের স্টীলে অনেক বেশী ছিল আধুনিক স্টিলের তুলনায় – কার্বন, অক্সিজেন, সালফার এবং ফসফরাস।  আর এই জিনিস গুলি ইস্পাতের ‘লো-টেম্পেরেচার প্রপার্টি’ খারাপ করে দেয়। আজকের দিনের স্টিল কতটা ভালো? ‘লো-টেম্পেরেচার প্রপার্টি’ কেমন করে মাপা হয় দেখা যাক – আমরা করি কি, যে ইস্পাতকে মাপতে চাই, তার থেকে স্যাম্পেল বানিয়ে খুব ঠান্ডা করি, মানে যে তাপমাত্রায় আপনি মাপতে চান আর কি। তার পর সেই স্যাম্পেলটিকে একটা হাতুড়ি দিয়ে দুম করে ঘা দেওয়া হয়।  স্যাম্পেলটি পট করে ভেঙে যাবার আগে কিছু এনার্জি শুষে নেয়। মানে বিনা ফাইট দিয়ে কেউ তো আর বডি ফেলবে না! সেই শুষে নেওয়া শক্তি আমরা নোট করে নিই – গালভরা নাম আছে একটা, ‘জুল’।  যে যত বেশী ‘জুল’ শুষে নিতে পারবে, তার ‘লো-টেম্পেরেচার প্রপার্টি’। এবার ভাবছেন, ভাই এই তোমাদের ধাতুবিদ্যা? হাতুড়ি দিয়ে ঘা মেরে ইস্পাতের বিচার করছ? এর মধ্যে সফিষ্টিকেশন কোথায়? কি আর উত্তর দিই – হাসি মুখে বলতে হয় যে, ধাতুবিদ্য জিনিসটাই এমন! তাই করে কম্মে খাচ্ছি এই বিষয়ে – সফিষ্টিকেশন থাকলে কি আর পারতাম!টাইটানিকের স্টিলকে পরীক্ষা করা হয়েছিল -২ ডিগ্রী সেন্টিগ্রাড তাপমাত্রায় – কারণ ১৯১২ সালের উত্তর আটল্যান্টিকে যেখানে টাইটানিক ডুবে গিয়েছিল সেখানে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল নাকি ওটাই।  তাই টাইটানিকের স্টিল কত ‘জুল’ দেখিয়েছিল হাতুড়ি মার্কা টেষ্টে? মাত্র চার জুল! হ্যাঁ, মাত্র চার জুল – মানে টাইটানিকের স্টীল লিকুইড নাইট্রোজেনে ডোবানো কলার মতই ভাঙ্গুর হয়ে ছিল – ছিল শুধু আপনার মটকানোর অপেক্ষায়, যেটা করে দিয়েছিল সেই হিম শৈলের আঘাত।  চার জুলের তুলনায় আজকের স্টিল -২ ডিগ্রী সেন্টিগ্রাড তাপমাত্রায় কত ভ্যালু দেয়? ৩২০ থেকে ৩২৫ জুলের মত! বুঝতে পারছেন পার্থক্যটা? আধুনিক যুগের ইস্পাতের ওই ‘নমনীয়-ভঙ্গুর পরিবর্তন’ তাপমাত্রা প্রায় -৪২ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডের মতন।  তাহলে কি এটা বলা যাবে যে টাইটানিক যদি আজকের দিনের ইস্পাত দিয়ে বানানো হত, তাহলে ১৯১২ সালের ১৪ই এপ্রিল রাতে সে ডুবতো না? এটা বলা খুব মুশকিল – কারণ ইস্পাতই যে একমাত্র ডোবার কারণ এমনটাও নয়।  আর আগে তো বলেইছি যে সেই একই সময়, একই শিপ ইয়ার্ড থেকে একই স্টিল দিয়ে বানানো জাহাজ অলেম্পিক ২০ বছর ধরে ইংল্যান্ড-নিউ ইয়র্ক যাত্রা চালিয়ে গ্যাছে দেদার!তাহলে পার্থক্য কি? ওই যে দেড়-তিন লক্ষ টনের হিমশৈল।আর কিছু? পরের পর্বে সেই নিয়ে নাড়াচড়া করা হবে।             
  • জনতার খেরোর খাতা...
    গুরু-সান্নিধ্যে - Pradhanna Mitra |        চিত্রকর রাণী চন্দের প্রায় সমগ্র জীবনটাই কেটেছে শান্তিনিকেতনে। এবং, এর মধ্যে প্রথম অর্ধ কেটেছে রবীন্দ্রসান্নিধ্যে। এই রবীন্দ্রসান্নিধ্য আবার যেমন তেমন করে নয়। একটা পর্যায় তো কেটেছে একেবারে প্রতিবেশী হিসাবে। শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ যে বাড়িতে থাকতেন, একদম তাঁর লাগোয়া বাড়ীতেই তিনি থাকতেন স্বামীসহযোগে। তাঁর স্বামী অনিল চন্দ। রবীন্দ্রনাথের সেক্রেটারি। রাণীর শুরুটা অবশ্য হয়েছিল শান্তিনিকেতনের আশ্রমিক হিসাবে।       রাণী চন্দের দাদা মুকুল দে গভর্মেন্ট আর্ট কলেজের অধ্যক্ষ, প্রথম অধ্যক্ষ। রাণীর রক্তে ছিল চিত্রকলা। রবীন্দ্র-উপদেশে শান্তিনিকেতনে রাণী ভর্তি হন কলাভবনে। অবন ঠাকুর, নন্দলাল বসুর স্নেহধন্যা রাণীর কয়েকটি মাত্র চিত্রকলা দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে, ইন্টারনেটের সৌজন্যে। Mother and Child ছবিটার দিকে যে আমি কতক্ষণ তাকিয়েছিলাম মনে নেই। রাণী ছবি আঁকা শিখলেও নিজের ছবি নিয়ে ততটা সংবেদনশীল ছিলেন কি? না কি শান্তিনিকেতনের অন্যান্য খ্যাতনামা চিত্রকরদের দাপটে তাঁর কাজ অনেকটাই ম্লান হয়ে গেছে? অবশ্য নারী চিত্রকরদের কজনকেই বা আমরা চিনি, বিশেষত শান্তিনিকেতনের?       তো এই রাণী কলাভবনে নন্দলাল বোসের তত্ত্বাবধানে ছবি আঁকা শিখতে লাগলেন। একসময়ে অনিল চন্দের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথের প্রতিবেশিনী হয়ে এলেন। দিনের পর দিন রবীন্দ্রনাথকে দেখেছিলেন নিকট থেকে। এমনকি ছবি আঁকার সময়েও রবীন্দ্রনাথকে সহায়তা করতেন। রবীন্দ্রনাথের অ-প্রথাগত আঁকার মেজাজ-মর্জির সাথে রাণী এতটাই পরিচিত ছিলেন যে, বুঝতে পারতেন, কখন কি প্রয়োজন। ফলে ছবি আঁকার সময় হলে রাণীর উপস্থিতি ছিল রবীন্দ্রনাথের কাছে অতি-প্রয়োজনীয়।       এই অতি-প্রয়োজনীতার আরেকটি উদাহরণ দেওয়া অতিপ্রয়োজন। রবীন্দ্রজীবনের একদম শেষ অঙ্কে রবীন্দ্রনাথের অন্তিম কাব্যগ্রন্থ ‘শেষ লেখা’। এটি অসম্পূর্ণ এবং এর মধ্যে দু-একটি কবিতা অসংশোধিতও বটে। কিন্তু বলার কথা এই যে, রবীন্দ্রনাথের পক্ষে সেই সময়ে নিজের হাতে লেখার ক্ষমতাটুকুও চলে গিয়েছিল। তিনি মুখে মুখে কবিতাগুলো বলতেন, রাণী শুনতেন, এবং লিখে রাখতেন। রবীন্দ্রকবিতা এবং রবীন্দ্রমানসিকতার সাথে রাণী এতটাই পরিচিত ছিলেন যে, কোথায় কোন কবিতায় কতটা স্পেস কিম্বা লাইনে ছেদ টেনে পরের লাইন লিখতে হবে, সেটা পর্যন্তও তিনি বুঝতে পারতেন এবং রবীন্দ্রনাথ তাঁর অনুমোদনও করতেন। ফলে ‘শেষ লেখা’ কাব্যগ্রন্থের অধিকাংশ কবিতাই সফলভাবে অনুলিখিত।        এহেন রাণী নিজেও লিখতে জানতেন। আর লিখতে জানতেন বলেই শুরু করেছিলেন তাঁর গুরু অবন ঠাকুরের মুখনিঃসৃত কথাগুচ্ছ। রবীন্দ্রনাথ তা পড়ে শুধু আনন্দিতই হন নি, রীতিমতো রাণীকে তাড়া দিতেন জোড়াসাঁকোয় গিয়ে আরোও লিখে আসতে। অবন ঠাকুরের কথাবিলাস ‘ঘরোয়া’ গ্রন্থে পাওয়া যায়। আমার পড়া হয় নি। পড়ার ইচ্ছা আছে। ‘গুরুদেব’ বইটিতে রাণী লিখছেন,        “যেদিন পড়া শেষ হয়ে গেল কাগজগুলি সরিয়ে নেব বলে উঠে এগিয়ে এলাম। গুরুদেব কোলের-উপর-রাখা লেখাগুলির উপর বাঁ হাতখানি চাপা দিয়ে রইলেন।আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। গুরুদেব বললেন, রথীকে ডাক।       রথীদাকে ডেকে আনলাম। রথীদা এসে দাঁড়ালেন পিছনে; গুরুদেব বুঝতে পারলেন। লেখার কাগজগুলি হাতে নিয়ে ঘাড়ের পাশ দিয়ে তুলে ধরলেন, বললেন, প্রেসে দাও।       রথীদা লেখাগুলো নিয়ে ফিরে চলে গেলেন।       এই হল ‘ঘরোয়া’ বইয়ের সূত্রপাত।”       আমার বলার উদ্দেশ্য রাণীর লেখনীশক্তির প্রতি দৃষ্টিপাত করা। সহজ সরল সাধারণভাবে রাণী লিখেছেন দৈনন্দিন চালচিত্র। সেখানে আসলেই তিনি লেখিকা নন, তিনি শান্তিনিকেতনের এক আটপৌরে নারী। যে নারীর বুকে সুখ এবং দুঃখ দুটোই খেলা করে। আর খেলা করে বলেই এই বই ‘গুরুদেব’ শুরু হয়েছে হঠাৎ করে, শেষও হয়েছে হঠাৎ করে। কোন উপসংহার নেই, কোন সূচনা-ভূমিকা নেই। আর সুখ দুঃখ আছে বলেই ‘আটপৌরে রবীন্দ্রনাথ’ ধরা পড়েছেন।       ‘আটপৌরে রবীন্দ্রনাথ’ আসলে কি বস্তু? এই প্রসঙ্গে আসার আগে বলে নিই, রবীন্দ্রনাথ দিনের শেষে ‘ঠাকুর’ নন, রক্তমাংসের মানুষ। ফলে তাঁর মধ্যে আলো-অন্ধকার আছে। আর আলো-অন্ধকার আছে বলেই না মানুষের অন্তরের এত বোধ তিনি এত অনন্যভাবে লিখে যেতে পেরেছেন। ফলে তাঁর অসাধারণত্বের কথা যেমন বলতে হবে, তেমনই তাঁর খামখেয়ালীপনার কথাও বলতে হবে বৈ কি।       রাণী সব উগড়ে দিয়েছেন এই বইটিতে, তবে বড়ো মোলায়েমভাবে, নচেৎ এই বই বিশ্বভারতী প্রকাশ করতেন না, আর তাছাড়া এই মোলায়েমতা রানীর স্বভাবজ। এটা শান্তিনিকেতনের প্রকৃতির প্রভাব অথবা রবীন্দ্রপ্রভাব অথবা দুটোই, বলা মুশকিল। দিনের শেষে সব দোষ-গুণের ঊর্ধ্বে গিয়ে মানুষ রবীন্দ্রনাথও সাধারণ মানুষের থেকে অনেকটাই এগিয়ে থাকেন। সেখানে দু-একটা ঘটনা যদি আঘাত করেই থাকে, তা-ই কি দিনের শেষে বড়ো হয়ে দাঁড়ায়? না তো। রাণী যেমন পরিপূর্ণ হয়েছেন, রাণী তেমনি ভেঙে টুকরো টুকরোও হয়েছেন। অনেক সময় যেমন রাণীর মতামতের গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন বোধ হয় নি, তেমন, অনেক সময়, আবার, তাকে ছাড়া চলেও নি। সব মিলিয়ে জিতভূমের এই বাসিন্দা রবীন্দ্রপাদপ্রদীপের আলোয় আপনাকে তুলে ধরেছেন অন্যরকমভাবে।       রাণীর লেখা প্রথম বই আমি পড়েছি ‘সব হতে আপন’। তারপর পড়লাম ‘গুরুদেব’। পূর্বের বইয়ের অনেক ঘটনাই এই বইটিতে অন্যভাবে এসেছে, স্বাভাবিকভাবেই। এই বইটার কেন্দ্রে শান্তিনিকেতন নয়। এই বইটার কেন্দ্র রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যদি শুধুমাত্র প্রশংসাগুচ্ছ তিনি লিখতেন, মেয়ে মানুষের মায়া বলে আমি এড়িয়ে যেতাম, এত কথা বলার প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু যেখানে একজন শিল্পী স্বাধীনভাবে ঘটনাপ্রবাহকে বলে চলেছেন, এবং তিনি জানেন, কোথাও কয়েকটি ঘটনা রবীন্দ্রভাবমুর্তিকে দারুনভাবে আঘাত করতে পারে, তা স্বত্ত্বেও তিনি সত্য থেকে বিচ্যুত হন নি। কারণটিও রবীন্দ্রনাথ। তিনি যে কিছুতেই চান নি সত্য হতে বিচ্যুত হতে। ফলে রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাছে বারোমাসের রবীন্দ্রনাথ। আর বারোমাসের রবীন্দ্রনাথের বারোমাস্যা নিয়েই তাঁর নিবেদন ‘গুরুদেব’।===============================গুরুদেবরাণী চন্দবিশ্বভারতী প্রকাশন বিভাগমুদ্রিত মূল্যঃ ১৬০টাকাছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা 
    ঢেকুর  - Tanima Hazra | শেষ অব্দি ওই ঢেকুরটাই দিলো সব বারোটা বাজিয়ে। বেশ চলছিল ওদের সম্পর্কটা। বড়বাজারে গিলোটিলালার গদিতে খাতা লেখে বির্জুপ্রসাদ,  উত্তরপ্রদেশের জৌনপুরের ছেলে, মামা গুলবন্তীলাল কোলকাতা থেকে কীসব পাইকারি জিনিসের ব্যবসা করে। সেই জুটিয়ে দিয়েছিল কাজটা। জৌনপুর থেকে বাসে আরও ভিতরে বোগলি, খুব ছোট গঞ্জ-গ্রাম, সেখানকার ছেলে বির্জু। একেবারে শুদ্ধ শাকাহারী ব্রাহ্মণ পরিবারের ছেলে, তাদের তিনকুলে কেউ আমিষের স্বাদগন্ধ শুঁকে দেখা তো দূরে থাকুক, পেঁয়াজ রসুন অব্দি শোঁকেনি কিংবা চাখেনি। ঘরে বউ বাচ্চা রেখে এসে ভালো টাকার আশায় এই গদীতে খাতা লেখার কাজ, বাড়িঘর ছেড়ে এতোটা দূরে।গাঁয়ে ক্ষেতিবাড়ির কাজ সামলায় তার আরও  মুখ্যুসুখ্যু দুইভাই, তাদের ব্যস ওই নাম সই অব্দিই বিদ্যে। বির্জু বরাবরই একটু মাথাওয়ালা ছিল তাই ইস্কুলের গন্ডি পেরিয়েছে ওই মাটিগোবরের ঢাল ডিঙিয়ে।  ঘরে বউবাচ্চা, এদিকে শহরে পড়ে পড়ে শরীর শুখা ভুখা। ঘরের লোকের রুটি ডালের অতিরিক্ত আর একটু অতিরিক্ত সুখ  জোগাড় করতেই তো মিত্তিরদের গ্যারেজে নর্দমার আর মাছের মাংসের গন্ধ শুঁকে সারাবছর ঘামে জবজবে হয়ে কাটিয়ে এতো কষ্ট করা।  তাই বলে কী নিজের কথা ভাবতে হবে না একটু। প্যান্টের ভিতরে শরীর শক্ত হয়ে উঠে মাঝে মাঝেই নিজের জন্য কিছু চায়। ভেদিনালই খবরটা দিয়েছিল। হেদুয়ার ধারে রাত্তির দশটার পরে যা।  শরীর নরম করার দাওয়াই পেয়ে যাবি। বান্ধুলি, মেয়েটা বলেছিল ওর নাম, বাড়ি ক্যানিং। মাছ খাস? মাংস? প্রথম জিজ্ঞাস্য ছিল এটাই বির্জুর। যে মুখে মাছ, মাংস, পেঁয়াজ রসুন ঢোকে সে মুখে মুখ গলিয়ে চুমু খাবে কীকরে, শুদ্ধ শাকাহারী বলে কথা!  আরে না, না, পাগল নাকি? বেধবা যে, এক্কেবারে খাঁট্টি নিরিমিষ্যি জেবন গো বাবু।  যা রেট তাতে পুষিয়েও গিয়েছিল বেশ, তবে রোজ রোজ তো আর এই অভ্যাসের আয়েস করা যাবে না, তাতে টাকায়  পুষিয়ে ওঠা যাবে নাকি?  তাই, হপ্তায় একদিন হলেই চলবে। ঘরে মানি অর্ডার পাঠিয়ে, এখানে নিজের খাওয়া চালিয়ে দিব্যি শরীরের ঠাণ্ডাই মিলবে। এই  মাছ মাংসে ভরা বিদেশবিভুঁইয়ে শাকাহারী বেশ্যা অত মেলা সহজ নাকি?  বড্ড ভাগ্যিজোরে পাওয়া গেছে মেয়েটাকে।  সবই শিউজীর কিরপা। প্যান্টের চেন আটকাতে আটকাতে পৈতেটায় তাই আলগোছে পেন্নাম ঠোকে বির্জু। এভাবেই মাস আষ্টেক  দিব্যি পেরলো। হপ্তায় একদিন করে আসবার কথা বলা ছিল মেয়েটাকে ।  খালের ধারের ওই নির্দিষ্ট  অন্ধকারটায়। মেয়েটা ভালো, কোনো ঝামেলা উমেলা নেই, টেইমেরও গলতি হেরফের নেই।  টাকা উকা নিয়েও ঝুনঝাট নেই।  আজও সব কিছু ঠিক ঠাকই ছিল, বেলাউজ খুলেছে, কাপড়ও তুলেছে, জায়গার জিনিস জায়গায় প্রবেশ করে সর্বোচ্চ স্বস্তি খুঁজছে, শরীর চাপের উপর চাপ সইছে, এমন তুঙ্গ মুহূর্তে  হঠাৎই বেয়াক্কেলে ওই ঢেকুরটা এক্কেবারে নাকের ডগায় গ্যাজগ্যাজে মাংস আর রসুনের গন্ধ ছড়িয়ে বেরিয়ে এলো মাগীর গলা দিয়ে।  বির্জু ধাক্কা দিয়ে ফেলে দ্যায় তাকে নীচে। তু নে বোলি থী তু শাকাহারী হ্যায়।  আজ ইদের দাওয়াতে দুফুরে গোস্তটা একটু বেশিই খাওয়া হয়ে গেছিল। টেরেনে উঠবার আগে দুবার করে ক্লোজাপ দিয়ে মুখ ধুয়েছিল রশিদা। যাতে কাষ্টমার টের না পায় জেতের হিসাব। কী করে বুঝবে, শালার ওই ঢেকুর হারামিটার জন্য সব লুকাছুপি বরবাদ হয়ে যাবে। মুখ নীচু করে থাকে সে। বলে, তাহলে আর আসতে হবেক নাই আসছে হপ্তা থিকা, তাই তো?   বিড়িটা ধরিয়ে চুপ করে বসে আছে বির্জু।  হঠাৎই ধাক্কাটা মেরে বড্ড লজ্জিত, লাগেনি তো মাগীটার। বলতেও পারছে না, পাছে ওর প্রতি দূর্বলতা প্রকাশ পেয়ে যায় ওর কাছে। আজ এক ঝটকায় শরীরটা থমকে গেল, হয়তো এতদিনকার আদ্যন্ত ভাবনাচিন্তার বেড়াজালগুলোও। অন্ধকারে চোট পাওয়া মেয়েমানুষটার চোখের কোণের জলের চিকচিক দেখা যায় না।গোড়ালির কাছটা ছড়ে গেছে অত জোরসে ধাক্কায় পাশের সিমেন্টে ছিটকে গিয়ে  ঘষা খেয়ে, জ্বলছে জায়গাটা, হয়তো রক্তও বেরিয়েছে। চেপে যায় রশিদা কথাটা। বলে, যে কথাটা তোকে বলা হয়নি যাবার আগে জেনে রাখ তুই, আমার নাম রশিদা বিবি, লিবাস কেনিং, সোহর ব্যাটা আজ চোদ্দ বছর বিছানায় হেগেমুতে পড়ে আছে, ঘরে পাঁচ পাঁচটা গেঁড়ি গুগলি বাচ্চা।  "ঠিক আছে ঠিক আছে, আর তোর জাত হিষ্টিরি শুনবার জরুরত নেই আমার। আর সব দিন যা পারিস কর তুই, শুধু এতবার (রবিবার) কা দিন কুছ মাস মছলি লইসান পিয়াজ খাবি না ব্যস, তাহলেই হবে, প্রাণভরে চুমু খেয়ে পুষিয়ে দেবো তোর যত আমিষের লোভ" এ কী আজগুবি উক্তি বেরিয়ে এলো রে বির্জুর মুখ থেকে, নাকি ওই ঢেকুরটার মতন এক্কেবারে বুক থেকে? রশিদা খুব হেসে ওঠে একচোট, হাসতে হাসতে চোখের জলে গাল এক্কেবারে থইথই। সে জানে না এই জল খুশির নাকি দুক্ষুর, সে শুধু এটা জানে তার রবিবারের বাঁধাধরা আয়টা কাটতে কাটতে খুব জোর  বেঁচে গেলো। খিলখিলিয়ে সে বলে ওঠে, ঠিক আছে রে জৌনপুরী, আজ থেকে প্রতি রোববার তোর জন্যি আমি একাদশী বোরতো পালন করব, হান্ডেড পাসসেন খাঁট্টি বেধবা, একেবারে শুদ্ধ শরীর, আর খাঁটি শাকাহারী ঢেকুর তুলতে তুলতে আসবো তোর কাছে, আজ থেকে আর কোনো টুথপেষ্ট এর আড়াল নেই।। 
    জেলার রাজধানীর রহস্য  - সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায় | উনিজির বক্তৃতালেখক মালপোয়াভাই হেবি বিপদে। উনিজি চুঁচুড়ায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা আবৃত্তি করবেন, কিন্তু উনিজিকে সমস্যার কথাটা কিছু বলা যাচ্ছেনা। কারণ, মেজাজ খারাপ। ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল বঙ্গাল আসার সময়ই। ট্রেন এক স্টেশনে দাঁড়াল, এক হকারের কাছে জায়গাটার নাম জিজ্ঞাসা করতেই সে ব্যাটা বলে এটা মোগল সরাই। কী খাবার আছে, জিজ্ঞাসা করতে বলল মোগলাই পরোটা। শব্দটাই উনিজির কাছে বলা বারণ। তিনি ধৈর্য ধরে বোঝালেন বটে, জিনিসটার নাম এখন দীনদয়াল ত্রিকোণ, দীনদয়াল উপাধ্যায় এক মহান নেতা, তাঁর নাম সব সময় স্মরণ করা উচিত, ইত্যাদি। কিন্তু খেলেন না। তখন থেকেই মেজাজ খিঁচড়ে। চন্দননগরে যে  বঙ্গালির বাড়িতে থাকবেন, সে আরেক জিনিস। দেখা হতেই দাঁত বার করে বলে, আজকে আপনার জন্য পুরো নিরামিষ। উনিজি ভদ্রতা করে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কী খাবে? সে আরও দাঁত বার করে বলল, আমাদের কাল ছিল পাঁঠা। আজ তো পড়েছি মোগলের হাতে, খানা খেতে হবে সাথে। শুনে তো উনিজির আক্কেল গুড়ুম। শুধু মোগল নয়, সঙ্গে পাঠানও বলছে। সঙ্গে সঙ্গে খাবার ফেলে উঠে গেলেন। সেই থেকে কথা বন্ধ। তাতেই মালপোয়াভাই গেছেন ফেঁসে। কথাই বলতে না পারলে সমস্যার কথা বলবেন কীকরে। তিনি খুব রেগে বঙ্গালিকে বললেন, তোমরা পাঠান বললে কেন বল তো? সে খুব অবাক হয়ে বলল, তাহলে কি ছাগল বলা উচিত ছিল? মালপোয়াভাই বললেন হ্যাঁ। তারপর নিজের নোটবইতে ছাগল কথাটা টুকে রাখলেন, কারণ কাকে কী বলতে হয়, এই নিয়ে বঙ্গালিদের জন্য উনি একটা বই লিখছেন। সেখানে এটা থাকবে। তারপর বললেন, কথাটা যেন মনে থাকে। তাতে অবশ্য এই সমস্যার কোনো সমাধান হলনা। কারণ উনিজি বক্তৃতার আগে পর্যন্ত মৌনী নিয়েছেন। মালপোয়াভাই কী আর করেন, নিজেকেই পুরো কাজটা করতে হল।পরদিন মঞ্চে উঠে উনিজি মৌনী ভাঙলেন। তারপর মালপোয়াজি পিছন থেকে প্রম্পট করতে লাগলেন, আর উনিজি বক্তৃতা দেওয়া শুরু করলেনঃ  হুগলী জেলার এই রাজধানীর পাশেই রবিন্দরনাথ থাকতেন। এটা রাজধানী হল কেন? কারণ, রবিন্দরজি বলেছেন, হেথায় আর্য, হেথা অনার্য, হেথায় দ্রাবিড় চীনশক হুন দীনদয়াল-ছাগল এক দেহে হল লীন।  #উনিজিকথামৃত ১৩ 
  • ভাট...
    comment | হুঁ 
    commentঅরিন | তবে শ্যাম রঙ্গিলা দাঁড়ালে উনিজির একটা রিয়েল লাইফ ডিপ ফেক মার্কা এমন‌ গোলমেলে ব্যাপার হতে পারত যে মনে হয় "বড় ভাঁড়ের" ম্যানেজাররা ঘাবড়ে গেছে। 
     
    comment | অভিনেতা ও মিমিক শ্যাম রঙ্গিলাকে বেনারস থেকে নমিনেশান ফাইল করতে দেওয়া হল না।  একটা কেন্দ্রে একজনের বেশী ভাঁড়কে দাঁড়াতে দেয় না আর কি। 
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত